বিহার ধাপ – বগুড়া

বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিহার ধাপ(Bihar Dhap)। প্রত্নস্থল ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় থেকে প্রায় প্রায় ৪ কিমি উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। স্থানটি তোতারাম পন্ডিতের বাড়ি নামেও পরিচিত।

এক সময় ঢিবি আকৃতির প্রত্নস্থলটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ২৫০ মি এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২২০ মি দীর্ঘ এবং চারদিকের ভূমি থেকে প্রায় ২ মি উঁচু ছিল। প্রত্নস্থলটিতে ১৯৭৯-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক খননের ফলে পশ্চিম অংশে পাশাপাশি দু’টি বৌদ্ধ বিহার এবং পূর্ব দিকে একটি মন্দিরের অবকাঠামো আংশিকভাবে উন্মোচিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালে পুনরায় ধারাবাহিক খনন কার্যক্রম শুরু হলে পূর্বে আবিস্কৃত মন্দিরের পাশে আরেকটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কিয়দংশ উন্মোচিত হয়েছে। মন্দির দু’টির প্রবেশ পথ উত্তর দিকে।

বিহার উৎখননের (১৯৭৯-৮৬) ফলে উত্তর-দক্ষিণে ৫৭ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৬১ মি দৈর্ঘ্যের একটি বিহার আবিস্কৃত হয়েছে।বিহারের মাঝখানে রয়েছে একটি উন্মুক্ত আঙ্গিনা এবং আঙ্গিনার চারপাশে ৩৭টি ভিক্ষু কক্ষ বিন্যস্ত রয়েছে। উত্তর এবং দক্ষিণ বাহুতে ১০টি করে কক্ষ, পূর্ব দিকে ৮টি এবং পশ্চিম দিকে ৯টি কক্ষ রয়েছে। বিহারের পশ্চিম দিকে রয়েছে প্রবেশ তোরণ, যার আয়তন ২০.৮ মি × ৬.৪ মি। তোরণটির বাইরের দিকে সম্ভবত দুটি প্রহরী কক্ষ ছিল যেগুলোর আয়তন ৬.৩৩ মি × ৫.৯ মি।

বিহার কক্ষের প্রাচীরের পুরুত্ব ২ মি থেকে ২.৬ মি। টিকে থাকা একমাত্র দরজাটি ১.৪ মি চওড়া। পূর্বদিকের দুটি কক্ষে মূর্তি রাখার বেদি পাওয়া গেছে। কক্ষগুলোর সামনে ২.৭ মি চওড়া টানা বারান্দা রয়েছে। তবে, দক্ষিণ বাহুর পশ্চিম অংশে ২.৩ মি × ১.৩৩ মি আয়তনের একটি ইটের মঞ্চ পাওয়া গেছে। ৬.২ মি × ৩.৬ মি আয়তনের পাঁচটি কক্ষে উৎখনন কাজ করা হয়েছে। এগুলোর একটিতে ২.২ বর্গমিটার পরিমাপের একটি বেদি পাওয়া গেছে। এই কক্ষটির পেছনের দেয়াল ২.৫ মি. পুরু এবং সামনের দেয়াল ১.৮ মি পুরু। পার্টিশন প্রাচীরের গুরুত্ব ১.২ মি। প্রত্নস্থলটির (সম্ভাব্য) অন্য একটি বিহারের তুলনায় সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত এই বিহারটি পরবর্তী পর্যায়ের অর্থাৎ দ্বিতীয় নির্মাণ যুগের নিদর্শন।

সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত বিহারের দক্ষিণ-পূর্বকোণের পূর্বপাশে ২২.৩৪ মি খননের পরে পাঁচটি নির্মাণযুগের স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটিও কোনো বিহারেরই ধ্বংসাবশেষ বলে ধারণা করা হয়।

মন্দির-১ প্রথম মন্দিরটি পূর্ব-পশ্চিমে ৫ মি এবং উত্তর-দক্ষিণে সম্ভবত ৬ মি দীর্ঘ। মন্দিরের উত্তর দিকে ছিল মূল প্রবেশ পথ। এটি ছয় ধাপ বিশিষ্ট। প্রতিটি ধাপ ২৪ সেমি চওড়া এবং ২৭ সেমি উঁচু এবং ১.৭০ সেমি লম্বা। প্রথম নির্মাণ যুগের মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় নির্মাণ যুগে পুরনো মন্দিরের সাথে যুক্ত করে পশ্চিম দিকে একটি নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। সেই সঙ্গে পুরানো মন্দিরটিও পুনর্নির্মাণ করা হয়। ফলে এটি একটি মন্দির কমপ্লেক্সে রূপ নেয়। প্রথম নির্মাণ যুগে মন্দিরের দেয়াল পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সজ্জিত করা হলেও দ্বিতীয় নির্মাণ যুগে ফলকের ব্যবহার দেখা যায় না। এ যুগে দেয়ালে মসৃণ ইট ব্যবহার করা হয় এবং তাতে ১৫ সেমি গভীর ও ১৪ সেমি চওড়া টানা খাঁজ নকশা করা হয়। তৃতীয় নির্মাণ যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো দেয়ালে ২ সেমি. পুরু পলেস্তরার ব্যবহার। যা বজ্রলেপ নামে পরিচিত। ইটের গুড়া ও কাদামাটির তৈরি এ আস্তর এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রাচীন মন্দির স্থাপত্যে আবিষ্কৃত হয়নি। প্রথম মন্দিরটিতে তিনটি নির্মাণ যুগের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

মন্দির-২ মন্দিরটি মন্দির-১ এর দ্বিতীয় নির্মাণ যুগে নির্মিত পশ্চিম দিকের ধ্বংসাবশেষের সাথে যুক্ত করে নির্মাণ করা হয়। ফলে মন্দির-১ এর পশ্চিম দেয়াল ও মন্দির-২ এর পূর্ব দেয়াল একটি সাধারণ দেয়াল হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। খনন কাজ সম্পূর্ণ না হওয়ায় এখনো মন্দিরের পুরো নকশা উন্মোচিত হয়নি। তবে, এ পর্যন্ত মন্দিরের পূর্ব-পশ্চিমের ১২ মি এবং উত্তর-দক্ষিণের ৯.৫০ মি অংশ উন্মোচিত হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশ পথ, প্রদক্ষিণ পথ ও মেঝে অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হলেও অন্যান্য অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে আঙ্গিনা এবং আঙ্গিনার পরে রয়েছে বেদি। এর পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর বাহু ৫২ সেমি চওড়া ও প্রদক্ষিণ পথের মেঝে প্রথমে ইট বিছিয়ে তার উপর টুকরা ইট, ইটের কণা ও আঠালো মাটি পিটিয়ে শক্তভাবে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের সামনের দেয়াল দু’সারি পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সজ্জিত ছিল। মন্দিরের প্রবেশ পথটি দশ ধাপ বিশিষ্ট।

বিহার ধাপ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্ত্ত পাওয়া গেছে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সুলতান সিকান্দার শাহ-এর (১৩৫৮-১৩৯০) একটি রৌপ্য মুদ্রা, ৬০টি পোড়ামাটির ফলক চিত্র, পোড়ামাটির সিল, ১০০টি নকশা অঙ্কিত ইট, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির গোলক, ধূপদানী, কুপি, কাঁচের পুঁতি, পোড়ামাটির পুঁতি, খেলনা, ব্রোঞ্জ নিদর্শন, খড়িমাটি এবং লোহার পেরেক।

প্রথম নির্মাণ যুগের স্থাপত্যকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট প্রত্নবস্ত্তর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ যুগের কাল নির্ধারণ করা হয়েছে চার অথবা পাঁচ শতক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্মাণ যুগ ছয় থেকে দশ শতকের বলে ধারণা করা হয়। চতুর্থ থেকে পঞ্চম নির্মাণ যুগের স্থাপত্যকর্মে প্রায় ক্ষেত্রেই পুরানো ইটের পুনর্ব্যবহার হয়েছে। আনুমানিক এগারো থেকে বারো শতকের মধ্যে এই প্রত্নস্থলের পতন ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: ভ্রমণ পাগল,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 21, 2018

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.