গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার – ঝিনাইদহ

বারবাজারের ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান হিসাবে গাজী-কালু-চম্পাবতীর মাজার(Gazi Kalu and Champabati Mazar) শরীফ দিনে দিনে তার ভক্তশ্রোতা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর এখানে ওরশ শরীফ পালন করা হয়। আর এই ওরশ শরীফে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। মত দ্বৈততা থাকলেও এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, গাজী- কালু ও চম্পাবতীর মাজার বারোবাজারেই অবস্থিত।

গাজী- কালু ও চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তী। জনশ্রততিতে পাওয়া যায় বিরাট নগরের শাসক দরবেশ শাহ্ সিকান্দারের পুত্র গাজী। কালু সিকান্দারের পোষ্য পুত্র । কালু গাজীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সর্বত্র তাকে অনুসরণ করতেন। গাজীর সাথে ছাপাই নগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতীর দেখা হয়। গাজী ভুলে গেলেন তিনি মুসলমান, চম্পাবতীও ভুলে গেলেন তিনি হিন্দু রাজার মেয়ে। তদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তাদের মিলনের মাঝে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল সামাজিক ও ধর্মীয় বাঁধা। রাজা তাঁর সেনাপতিদের হুকুম দিলেন গাজী ও কালুকে শায়েস্তা করতে। ঘোর যুদ্ধে মুকুট রায়ের সেনাপতি দক্ষিণা রায় পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গাজীর অনুসারী হয়। গাজী- কালু ও চম্পাবতীর মাজারের সাথে দক্ষিণা রায়ের মাজার আছে। মুকুটরাজা ঝিনাইদহ, কোটচাঁদপুর, বারোবাজারের পূর্ব এলাকা ও বেনাপোল অঞ্চলের সামস্ত রাজা ছিলেন। অন্যত্র তিনি রামচন্দ্র, শ্রীরাম বলে পরিচিত। রাজার চারটি বাড়ি ছিল-ঝিনাইদহের বাড়িবাথান, বারোবাজারের ছাপাইনগর (বর্তমানে বাদুরগাছা), কোটচাঁদপুরের জয়দিয়া বাওড়ের বলরামনগর, বেনাপোলের কাগজপুর-এ।

এ মুকুট রাজা বা রাজা রামচন্দ্র গাজীর অনুসারী বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে চম্পাবতীকে নিয়ে তার প্রধান বাড়ি ঝিনাইদহের বাড়িবাথানে চলে আসেন। গাজীও তাকে অনুসরণ করেন। ঝিনাইদহে গিয়ে গাজী, রাজার সেনাপতি গয়েশ রায়ের প্রমোদ ভবন জালিবল্লা পুকুরের পাড়ে বদমতলীতে ছাউনি ফেলেন।

এখানেও গাজীর মাজার দেখতে পাওয়া যায়। এরপর রাজা চলে যান জয়দিয়া বাওড়ের বাড়িতে। এ বাড়ির অবস্থান দেখলে মনে হয়, রাজা অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন। জয়দিয়ার বাওড় একসময় ভৈরব নদের অংশ ছিল। বাওড়ের পূর্ব পাড়ে ছিল রাজার বাড়ি। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে বলুহর বাওড় যা এক সময়ে কপোতাক্ষ নদের অংশ ছিল। দুই বাওড় তথা দুই নদীর মধ্যস্থলে অবস্থিত এই রাজবাড়ীর গুরুত্ব অপরিসীম।

দক্ষিণ পাশে বাওড়ের কুল ঘেষে তমাল গাছের নিচে আজও গাজীর দরগা বিদ্যমান। হয়তো প্রেমের টানে গাজী এখানেও ছুটে এসেছিলেন সঙ্গী কালুকে নিয়ে। অবশেষে গাজী অনুসারীদের নিয়ে বহু খন্ড যুদ্ধের পর রাজা রামচন্দ্রের কাছ থেকে চম্পাবতীকে উদ্ধার করে বারোবাজার ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু গাজীর পিতা শাহ্ সিকান্দার বিষয়টা মেনে নেননি। মুকুট রাজা শাহ্ সিকান্দারের প্রতিবেশী। হিন্দু সমাজের অসন্তষ্টির কারণে তিনি গাজীকে বাড়ী উঠতে দেননি। বাধ্য হয়ে গাজী দরবেশ বেশে চম্পাবতীকে নিয়ে বাদাবনে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গী হলো কালু ও দক্ষিণা রায়। সুন্দরবনের বাদাবন বেশী দূরে ছিল না। নাভারণ, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, বনগাঁ বাদাবন অঞ্চল ছিল। অসীম সাহসী গাজী আস্তানা গাড়লেন বাদাবনে। গরীব কাঠুরিয়ারা তার ভক্ত হলো।

গাজীর পরিচয় সম্পর্কে আর একটি ঐতিহাসিক তথ্য প্রচলিত আছে আমরা যে ঘটনার অবতারণা করছি তা ঘটেছে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। হোসেন শাহের সময়কালে (১৪৯৩-১৫৩৮) মুকুট রাজার শাসন কাল ছিল খাঁনজাহান আলী পরবর্তীতে সুলতান রোকনউদ্দীনের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আসাব ও বাংলার বিভিন্ন অভিযানে তিনি অংশ নেন। সিলেট ও ঝিনাইদহের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর দরগা বা মাজার আছে। গাজী-কালু ও চম্পাবতীর সম্পর্কে নানা ধরণের জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।

গাজী- কালু ও চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাশে ৩টি পাশাপাশি কবরের অবস্থান । মাঝখানে বড় কবরটি গাজীর, পশ্চিমেরটি কালুর এবং পূর্বের ছোট কবরটি চম্পাবতীর বলে পরিচিত। মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে কূপ কিংবা অন্য কোন কবর বলে মনে করেন। ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিন শেড তৈরী করেছেন। গাজী কালু চম্পাবতীর সাথে দক্ষিণা রায়ের কবরও এখানে রয়েছে।

কিভাবে যাবেনঃ

ঝিনাইদহ হতে স্থানটির দুরত্ব ২৮-৩০ কিঃ মিঃ। ঝিনাইদহ হতে বাসযোগে সড়ক পথে বারবাজার যেতে হবে। এরপর বারবাজার হতে হতে( পূর্ব দিকে) ভ্যানযোগে গাজীকালু চম্পাবতীর মাজারে যেতে হবে। বারবাজার হতে মাজারের দুরত্ব ১ কিঃ মিঃ । বারবাজার মেইন ষ্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে ৯নং ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই অবস্থতি এই মাজার শরীফ। মাত্র ৫ টাকা ভ্যান অথবা করিমন ভাড়া দিয়ে আপনি যেতে পারেন।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: সাফায়েত,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 23, 2018

গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার – ঝিনাইদহ, সম্পর্কে পর্যটকদের রিভিউ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.