আলেকজান্ডার ক্যাসেল – ময়মনসিংহ

‘হাওর-জঙ্গল-মইষের শিং, এই তিনে ময়মনসিং’— প্রবাদ-প্রবচনে এভাবেই পরিচয় করানো হতো একসময়ের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহকে

সময়ের বিবর্তনে ছয় জেলায় রূপান্তর হলেও ময়মনসিংহ জেলা সদরের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য তাতে কমেনি। বিস্তীর্ণ এ জনপদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। ভূ-প্রকৃতির বৈচিত্র্যের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক জীবন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, জীবিকা ও সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সূতিকাগার হিসেবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাকে গড়ে তুলতে স্থানীয় রাজা-রাজড়া ও জমিদারদের বিশাল অবদান ছিল। ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। এ নদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বহু ছবি এঁকেছিলেন। এখানকার বহু স্থাপনায় প্রাচীন নির্মাণশৈলীর ছোঁয়া রয়েছে। আছে কালের সাক্ষী জমিদারবাড়ী। সে রকমই কিছু জমিদারবাড়ীর খোঁজ— যা একাধারে দৃষ্টিনন্দন ও ঐতিহ্যের বাহক।

আলেকজান্ডার ক্যাসেল: ঊনবিংশ শতকীয় স্থাপনা এ আলেকজান্ডার ক্যাসেল(Alexander Castle)। ১৮৭৯ সালে মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য এ প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। এতে সে সময় ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। ভবন চত্বরে ছিল দীঘি ও বাগান। ভবন নির্মাণে লোহা ব্যবহার বেশি হয়েছিল বলে এটি মানুষের কাছে ‘লোহার কুঠি’ নামেও পরিচিত লাভ করে। এখনো স্থানীয়ভাবে এ নামেই পরিচিত প্রাসাদটি। বর্তমানে এটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আলেকজান্ডার ক্যাসেল ময়মনসিংহ শহরের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর অন্যতম। শহরের কেন্দ্রস্থলে কোর্ট-কাচারি এলাকায় এর অবস্থান। বহু বরেণ্য ব্যক্তির পায়ের ধুলো পড়েছে এখানে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহ সফরকালে আলেকজান্ডার ক্যাসেলে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। এখানে আরো এসেছিলেন লর্ড কার্জন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, কামাল পাশা প্রমুখ।

শশী লজ: শশী লজ মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের বাড়ি, যা ময়মনসিংহের রাজবাড়ী নামেও খ্যাত। ব্রহ্মপুত্র নদের অদূরে শহরের কেন্দ্রস্থলে এ রাজবাড়ীর অবস্থান। পুরো বাড়িটি নয় একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে। মূল বাড়িটি নির্মাণ করেন মহারাজা সূর্যকান্ত। পরবর্তীতে তার দত্তকপুত্র শশীকান্ত প্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করেন। সূর্যকান্তের নির্মিত প্রাসাদটি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের এক প্রবল ভূমিকম্পে আংশিকভাবে ভেঙে যাওয়ার কারণে এটি করা হয়। শশী লজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরে প্রায় সব ঘরেই ছাদ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি। আছে নাচঘর, স্নানঘর। স্নানঘরে রয়েছে সুড়ঙ্গ। শোনা যায়, সুড়ঙ্গপথে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মূল ভবনের পেছন ভাগেও রয়েছে স্নানঘর। পেছনের স্নানঘরটি দোতলা। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে শ্বেত পাথরের ফোয়ারা, যার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের ভাস্কর্য। পাশেই রয়েছে পদ্মবাগান। বাড়িটির আশপাশে রয়েছে অসংখ্য গাছ-গাছালি। এখানে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমানে এটি ‘ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এ শশী লজেই হয়েছিল বিটিভিতে প্রচারিত, হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক ‘অয়োময়’-এর পর্বগুলোর শুটিং। নাটকে এটি ছিল জমিদারবাড়ী।

গৌরীপুর লজ: টিন, কাঠ ও লোহা দিয়ে সম্পূর্ণ এ দেশীয় পদ্ধতিতে রাজবাড়ীর আদলে তৈরি সুরম্য অট্টালিকা হলো গৌরীপুর লজ। ব্যালকনি, ড্রইং, ডাইনিংসহ ছোট-বড় প্রায় ২০টি কক্ষ আছে এ লজে। এ অট্টালিকার সামনে আছে মনোরম ফুলের বাগান। এর প্রতিষ্ঠাতা ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী কী কারণে এ লজ নির্মাণ করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে সঙ্গীতের সুমধুর রহস্য অনুসন্ধানে সচেষ্ট এ ব্যক্তির সঙ্গীত-পিপাসা নিবারণের জন্য আলাউদ্দিন আলী খাঁ, মুহম্মদ আলী খাঁ, হাফেজ আলী খাঁ, মুস্তফা খাঁ প্রমুখ সঙ্গীত বিশারদরা এসেছিলেন গৌরীপুর লজে। প্রায় ১ দশমিক ৩৬ একর জমির ওপর সবুজের সমারোহে, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গৌরীপুর লজ। বর্তমানে এ প্রাচীন অট্টালিকা সোনালী ব্যাংকের ময়মনসিংহ অঞ্চলের করপোরেট অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

কীভাবে যাবেন: মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার সরাসরি বাস আছে। সড়কপথে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে সময় লাগবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। সকালে রওনা দিলে সারা দিন ময়মনসিংহে ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যা নাগাদ আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে পারবেন। ভালোভাবে ঘুরে দেখতে চাইলে দুইদিন সময় নিয়ে যাওয়াটা ভালো। তবেই মন ভরে উপভোগ করতে পারবেন ঐতিহ্যের এ শহরকে।

অবস্থান:
ময়মনসিংহ সদর, ময়মনসিংহ

কিভাবে যাওয়া যায়:
যোগাযোগের মাধ্যম- সড়ক পথে যাওয়া যায় (ব্যক্তিগত যানবাহন/রিক্সা) ভাড়া-আনুমানিক ২০ টাকা সময়-আনুমানিক ৩০ মিনিট।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: আবদুর রহমান,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 27, 2018

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.