লালদিঘি(Lal Dighi) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থান সমূহের অন্যতম। নগরীর জেল রোডের শেষ সীমানায় এর অবস্থান। এর একপাশে আছে আন্দরকিল্লা। এর আশেপাশে আছে জেলা পরিষদ ভবন এবং স্থানীয় ব্যাঙ্কের শাখাসমূহ। এটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত।
১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামের শাসনভার লাভ করে। সেই সময় এন্তেকালী কাছারি অর্থাৎ জমি সংক্রান্ত তহসিল অফিসে (বর্তমানে মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিস) লাল রঙ দেয়া হয়েছিল। এটিকে লোকজন তাই “লালকুঠি” বলে চিনত। এই লাল কুঠির পুর্ব দিকে ছিল জেলখানা। এটিকে ও লাল রঙ করা হয়েছিল এবং তাই এটি “লালঘর” নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ভবন দুটো লাল পাগড়ী পরিহিত ব্রিটিশ পাহাড়াদারেরা পাহাড়া দিত। অনেকেই মনে করেন এ কারনেই ভবনগুলোর নাম লাল ঘর এবং লাল কুঠি। লাল ঘর এবং লাল কুঠির পাশে একটা ছোট পুকুর ছিলো। চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসনের সূচনালগ্ণে পুকুরটিকে বড় করে দিঘিতে পরিণত করা হয়। পাশেই দুটো লাল রঙের ভবন ছিল বলেই এই দিঘিটা লালদিঘি নামে পরিচিত হয়।
লালদিঘির মালিকানা
লালদিঘির উত্তর পাশে রয়েছে একটা মঠ যার গম্বুজে লেখা আছে ১৯৩৯ সাল। এটার গায়ে লেখা আছে রায় বাহাদুর রাজকমল ঘোষের নাম। রায় বাহাদুর ছিলেন একজন জমিদার। তাঁর নিজ বাড়ি ছিল রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামে। তিনি অবসর সময় কাটাতেন তখনকার খোলামেলা লালদিঘির পাড়ে। তিনি ছিলেন লালদিঘির অভিভাবক। পরবর্তিতে তিনি দিঘিটির মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেন।
রিকেট ঘাট
লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে ছিলো “রিকেট ঘাট”। ১৯৪১ হতে ১৯৪৮ পর্যন্ত চট্টগ্রামের কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করা স্যার হেনরী রিকেটস এর স্বরণে চট্টগ্রামের জমিদারেরা এই ঘাট নির্মান করেছিলেন। মিঃ হার্ভে ১৮৩১-১৮৩৯ সালে চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন। তিনি ৩২ ডেপুটি কালেক্টর ও কয়েকজন জরিপ আমিন নিয়ে জরিপের কাজ শুরু করেন। জরিপে তিনি ২০ গন্ডার স্থলে ১৮ গন্ডায় কানি হিসাব করেন। একারনে তাঁর উপর সবাই এত অসন্তুষ্ট হয়েছিল যে আনোয়ারা থানায় লোকজন তাকে আক্রমণ করে। তিনি তারপর সৈন্যদের গুলি করার নির্দেশ দেন। এই খবর পেয়ে কর্ত্পক্ষ মিঃ রিকেটকে প্রেরণ করে। ১২০০ মঘীর জরিপের সময় চট্টগ্রাম বাসীর উপকার করে তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতকে চট্টগ্রামের সেশন জজ টোডেল সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর শবদেহ রিকেট ঘাটের উত্তর দিকে দাহ করা হয়। তাঁর স্মৃতিতে নির্মান করা স্তম্ভটি পরবর্তীকালে ভেঙ্গে ফেলা হয়।
লালদিঘির ময়দান
মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পশ্চিমে পরীর পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত পুরো জায়গাটা সেকালে মিউনিসিপাল ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮৭ সালে এই ময়দানে মহারানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি স্থাপন করা হয়। চল্লিশের দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে এই মূর্তি অপসারন করা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষে উত্তর-দক্ষিন রাস্তাটি হবার পর মিউনিসিপাল ময়দান দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ব দিক সাধারন জনগনের খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়। মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সে মাঠ মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পরিনত হয়। এই মাঠ এখন লালদিঘির মাঠ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
লালদিঘির কিংবদন্তি
লাল দীঘির ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের মুখে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একবার এক দিনমজুরের মেয়ে ঐ দিঘীতে গোছল করতে নেমেছিলো। হঠাৎ পায়ে শিকল বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো জলের নিচে একটা দেশে। আসলে ঐটা ছিলো এক বাদশার দরবার। সেই বাদশার বিয়ে ঠিক হয়েছিল লাল বেগমের সাথে। একদিন বাদশা লাল বেগমকে দেখতে চাইলেন কিন্তু খবর পাওয়া গেলো লাল বেগম তার মুল্লক থেকে এক ক্রীতদাসের সাথে পালিয়েছে। এ খবর বাদশা তখন জানতেন না। তাই মজুরের ঐ মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে বাদশার সাথে লাল বেগমের অভিনয় করার জন্য। অনেক কথাপ্রসঙ্গে বাদশা মেয়েটার আসল পরিচয় জেনে যায়। ক্ষুদ্ধ বাদশার নির্দেশে সবাই আসল লাল বেগমকে খুজতে লেগে গেলো। তখন জানা গেলো সে অন্দর কিল্লার দীঘি থেকে দু’শ হাত দূরে পর্তুগীজদের কিল্লায় আছে। বাদশা ঐ কিল্লায় আক্রমণ করে। অনেক অনেক খুনে লাল হয়ে গেলো দিঘীর পানি। বাদশা পরাজিত হল সেই যুদ্ধে। সবাই পালিয়ে গেল। তবুও সে দিঘির পাড়ে বাদশা থেকে গেল লাল বেগমকে উদ্ধার করার আশা নিয়ে। এই নিয়ে একজন চারন কবি লিখেছেনঃ “লালদিঘিতে আগুন ধরে/জল শুকিয়ে গিয়েছে,/মাছগুলো সব ডাঙ্গায় উঠে/কিলবিল করতে লেগেছে“।
অনুষ্ঠান
লালদিঘির পাড়ে ১৯১০ সালে বৈশাখের ১২ তারিখ আবদুল জব্বার সর্বপ্রথম বলীখেলা অনুষ্ঠান করেন। তখন থেকে প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখ লালদিঘির পাড়ে জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।[ বর্তমানে লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি মসজিদ আছে। শহরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্য এখানে একটি সবুজ গাছপালা ঘেরা পার্ক আছে।
কিভাবে যাওয়া যায়:
উক্ত দশর্নীয় স্থানে যাওয়ার জন্য বাস বা অটোরিক্সা ব্যবহার করা যেতে পারে।
অবস্থান:
চট্টগ্রাম