চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় লুকিয়ে রয়েছে স্মৃতি বিজড়িত দর্শনীয় স্থান। এর ইতিকথা অনেকেই জানে না। যারা জানতো হয়তো অনেকেই এখন আর এ পৃথিবীতে নেই। তেমনি এক স্মৃতি বিজড়িত দর্শনীয় স্থান রয়েছে ফরিদগঞ্জ উপজেলার উত্তর রূপসা ইউনিয়নে। রূপসা বাজারেই তা কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আড়াই শ’ বছর ধরে। আর তা হলো জমিদার বাড়ি(Rupsha Zamindar Bari)। দেশের বিভিন্ন জেলার জমিদারদের চেয়ে রূপসা জমিদারগণ ছিলেন ভিন্নতর। আমরা শুনেছি বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে যারা জমিদারি করতো তারা ছিলো ভয়ানক স্বভাবের। অত্যাচারী আর নির্যাতনকারী। সেদিক থেকে রূপসা জমিদারগণ ছিলো একেবারেই ভিন্নতর।তারা ছিলো পরোপকারী। মানুষের আপদে-বিপদে সর্বদাই তারা নিবেদিকপ্রাণ হিসেবে ছুটে যেতো। রূপসার জমিদারগণ ছিলেন ধর্মপরায়ন।
এ বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে নজর দিলেই চোখে পড়ে যাবে অতি পুরানো ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ির দৃষ্টিনন্দিত প্রবেশদ্বার। এ প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা রয়েছে রূপসা জমিদার বাড়ি। প্রবেশদ্বার দিয়ে কয়েক কদম এগুলোই হাতের ডান পাশে রয়েছে জমিদারদের পুরনো কারুকাজে খচিত মসজিদ। মসজিদের দিকে তাকালেই যেনো নয়ন জুড়িয়ে যায়। মসজিদের বিপরীত পাশে অর্থাৎ দক্ষিণ পাশে রয়েছে জমিদারদের বংশভূতদের কবর। আর কবরগুলোতে রয়েছে ফলক। ফলকগুলোতে প্রয়াত জমিদারদের কীর্তির বর্ণনা লেখা রয়েছে। জমিদার বাড়ির ভেতরে রয়েছে বেশ ক’টি ছোট-বড় মঠ। আর এতে মনে হয় এটি এক সময় হিন্দু জমিদার থাকতো।
এখন থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর পূর্বে রূপসার খাজুরিয়া এলাকা সিংগেরগাঁও নামে পরিচিতি ছিলো। সেখানে বাইশ সিংহ পরিবার নামে এক হিন্দু পরিবার বসবাস করতো। সেই সিংহ পরিবারের জমিদারির পরিসমাপ্তি ঘটলে আহম্মদ রাজা চৌধুরী রূপসা জমিদার বাড়িতে জমিদারি শুরু করেন।
আর তার মাধ্যমেই রূপসায় জমিদারি শুরু হয়। তারপর এ জমিদারি দায়িত্ব এসে পড়ে মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর উপর। মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী ছিলেন দানশীল ব্যক্তি। মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী রূপসায় জমিদারি করাকালে এলাকার অসহায়দেরকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তার মৃত্যুর পর রূপসার জমিদারি ভার গ্রহণ করেন তারই পুত্র আহমেদ গাজী চৌধুরী। আহমেদ গাজী চৌধুরীর জমিদারি আমলে জমিদারি কায়দা কানুনের বিস্তৃতি প্রসারিত হয়। আহমেদ গাজী চৌধুরী নিজ কর্মগুণে আর কাজের মাধ্যমে নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। দয়া আর দানশীলতা ছিলো তার বৈশিষ্ট্য। জনকল্যাণ কাজের জন্যে তিনি জমি পর্যন্ত দান করেছেন। রূপসার সুপ্রাচীন মসজিদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা এখনো জমিদার বাড়িতে প্রবেশের সিংহদ্বারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তাই নয়, রূপসা আহম্মদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, আহম্মদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, লাউতলী দিঘি উল্লেখযোগ্য।
জমিদার বাড়িতে প্রবেশের প্রধান ফটকের সামনের পান সিগারেট দোকানী শতবর্ষ বয়সী এক ব্যক্তি। তাকে সবাই পাটোয়ারী বলে ডাকে। তিনি জানান, রশিদ চৌধুরীকে এলাকাবাসী সব সময় রসু চৌধুরী নামে ডাকতেন। রসু চৌধুরীর জমিদারির আমলে বহিরাগত লোকজন রূপসা বাজারে টোকেন ছাড়া প্রবেশ করতে পারতো না। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের বিভিন্ন জেলায় জমিদারদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিলো। কিন্তু রূপসার জমিদার রশিদ চৌধুরীর সম্পত্তি দখল করতে পারেনি। আইয়ুব খান এখানে এসেছিলেন। রশিদ চৌধুরীর সাথে বৈঠক করেছিলেন তখন রশিদ চৌধুরী তাকে বলেছিল, আপনি আমার কাছে কি চান। জমিদারির সম্পত্তি না অন্য কিছু। আইয়ুব খান কোনো কথার জবাব দিতে পারেনি। ব্যর্থ হয়ে রূপসা থেকে ফিরে গেছেন। রশিদ চৌধুরীর জমিদারির আমলে এ এলাকার মানুষকে চলাচলের জন্যে ফসলি জমি আইল নির্ধারণ করে দিয়ে ছিলো। তখন গ্রামবাসী সে পথেই চলাচল করতো। রশিদ চৌধুরী বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার দানশীলতা, দয়ার কথা আজো এলাকাবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। প্রতি বছর ঈদুল আযহার সময় তিনি ৩০/৪০টি গরু জবাই করে এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণ করতেন। গ্রামবাসী ও প্রজারা কখনোই জমিদার রশিদ চৌধুরীর রোষানলে পড়তে হয়নি। রশিদ চৌধুরী রূপসা এলাকার যতোগুলো বাজার রয়েছে প্রতিটি বাজারে মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছেন মুসল্লিদের জন্যে। শুধু তাই নয়, ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া মন্দিরের জন্যে তিনি অবদান স্বরূপ জমি দান করেছেন। রেখেছেন চাঁদপুর শহরের চৌধুরী জামে মসজিদে ও চৌধুরী ঘাটটি এ জমিদার বাড়ির জমিদারদের জনহিতকর অবদান।
রূপসা উত্তর ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোঃ জামাল উদ্দিন খান জানান, রূপসা জমিদার বাড়িটি প্রায় ৮ একর সম্পত্তির উপর। তাদের কতো সম্পত্তি রয়েছে তার হিসেব নেই। বর্তমানে জমিদার বাড়িতে প্রায় জমিদারদের অর্ধ শতাধিক পাইক পেয়াদারা বসবাস করছে বর্তমানে। ভেতর বাড়িতে এখনো রয়েছে বেশ কয়েকটি মঠ।