ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে উত্তর দিকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ভুল্লিবাজার। বাজার থেকে ডান দিকে তিন কিলোমিটার দূরে বালিয়া গ্রাম। সরু পাকা রাস্তা দুই পাশে ঘন গাছপালা যেন সবুজের রাজ্যের প্রবেশধার। আর একটু সামনে তাকালেই মনে হবে যেন মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনসমৃদ্ধ কোনো এলাকায়। গাছগাছালিঘেরা লালচে স্থাপনা। উঁচু গম্বুজ উঁকি দিচ্ছে। ছায়ামাখা শান্ত পরিবেশ। সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজঘর—এই তিন অংশ নিয়েই মসজিদ(Balia Mosjid) কমপ্লেক্স। ঢাকায় বিভিন্ন মোগল স্থাপনাগুলোর সঙ্গে বেশ মিল।
মসজিদে কোনো পিলার নেই। একটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এটি। মসজিদের ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরো বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। মসজিদটিতে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। লালচে ইট কেটে তৈরি করা হয়েছে নানা রকমের নকশা। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকী, কলস-বাটি ও পদ্ম আকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনো রকমের আস্তরণ নেই। সেই পুরনো অবয়বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওপরে তৈরি করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকের দৈর্ঘ্য ২১ ফুট, প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ রকম ফটকওয়ালা মসজিদ এ অঞ্চলে চোখে পড়ে না।
ইতিহাস থেকে জানা যায় পাইগুড়ি অঞ্চলের মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অধীনস্থ শালবাড়ী পরগনার স্থানীয় বালিয়ার জমিদারকন্যা গুলমতি চৌধুরানিই মূলত এই মসজিদের নির্মাতা বলে জানা যায়। তবে সব কর্মকাণ্ড তদারকি করতেন তাঁর স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী। তাঁর পূর্বপুরুষ মোগলদের সঙ্গে এই এলাকায় আসেন বলে জানা যায়। স্বামীর আগ্রহেই ১৮৬০ সালের দিকে মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করেন গুলমতি চৌধুরানি। এ জন্য দিল্লি থেকে নিয়ে আসেন কারিগরও। ১৯০৫ সালে মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত নানা ধাপে মসজিদের কাজ চলতে থাকে। এরপর নানা কারণে মসজিদটির কাজ আর এগোয়নি।
সময়ের পরিক্রমায় এ মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালে মসজিদটি আগের স্থাপত্যরীতীর সাথে মিল রেখে আবার পুনঃনির্মান করা হয়। এ রকম বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রাচীন মসজিদ একেবারে ব্যক্তিগত চেষ্টায় পুনর্নির্মাণের ঘটনা এ দেশে বিরলই বলা চলে। চমৎকার এই মসজিদ একনজর ঘুরে দেখার জন্য প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন।
আরো কিছু তথ্য – বালিয়ার পাশেই মলানি গ্রামে রয়েছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বসবাস। তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনাচার মুগ্ধ করবে। শীতে সাঁওতালদের অনেক রকম উৎসব থাকে। শীতকালে ঠাকুরগাঁওয়ের আরেক আকর্ষণ কাঞ্চনজংঘা দর্শন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বুড়ির বাঁধ এলাকা থেকে খালি চোখে কাঞ্চনজংঘা চোখে পড়ে।
কিভাবে যাবেন
এক ঘণ্টা পর পরই ঢাকার শ্যামলী, গাবতলী থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের কোচ ছাড়ে। ঠাকুরগাঁও পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। এসি গাড়িতে খরচ পড়বে ১১০০-১২০০ টাকা আর নন-এসিতে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। এ ছাড়া দিনাজপুরগামী আন্তনগর ট্রেন একতা, দ্রুতযান ও নীলসাগর এক্সপ্রেসে সৈয়দপুরে নামতে পারেন। সেখান থেকে বাসে করে ঠাকুরগাঁও। পুরনো বাসস্ট্যান্ড থেকে পঞ্চগড়গামী বাস কিংবা অটোরিকশায় ভুল্লি বাজার হয়ে বালিয়ায় যাওয়া যায়।