মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপালের অন্তর্গত রেকাবি বাজার ইউনিয়নের কাজী কসবা গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটি বহু গম্বুজবিশিষ্ট এবং ভূমি পরিকল্পনায় আয়তাকৃতির। এ মসজিদের অভ্যন্তর ভাগের পরিমাপ ১০.৩৫ মিটার × ৬.৭৫ মিটার এবং বহির্ভাগের পরিমাপ ১৪.৩০ মিটার × ১১.৪৫ মিটার। মসজিদটির দেয়াল ২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে তিনটি ‘বে’ ও দুটি ‘আইল’ আছে।
পশ্চিম দেয়ালের পশ্চাৎভাগ বাইরের দিকে তিন স্তরে বর্ধিত। পেছনের বর্ধিতাংশটি অতীব সুন্দর টেরাকোটা অলংকরণে নকশাকৃত, যার সাথে মোয়াজ্জমপুর মসজিদের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। মিহরাবের মাঝখানে এবং পূর্ব ফাসাদে ঝুলন্ত শিকল ঘণ্টা ও ঝুলন্ত তক্তীর নকশা রয়েছে। তাছাড়া কুলুঙ্গির মাঝখানে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান, জ্যামিতিক নকশা ও খিলান শীর্ষে ‘রোজেট’ নকশা লক্ষণীয়; এরূপ নকশাসমৃদ্ধ ‘ফাসাদ’ দেখতে পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জ জেলায় অবস্থিত শাহজাদপুর মসজিদে।
বিক্রমপুরের মহাপরাক্রমশালী রাজা বল্লাল সেন ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক। তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে মসজিদ গুলোকে মন্দিরে পরিণত করেন এবং বিক্রমপুরে গরু জবেহ ও আযান দিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করেন। রামপালের নিকটস্থ আব্দুল্লাহপুর গ্রামের কানাইচং মাঠের জনৈক মুসলমান তার পুত্রের জন্ম উপলক্ষে অতি সঙ্গোপনে গরু জবেহ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একটি চিল ছো মেরে এক টুকরো মাংস নিয়ে বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায় ফেলে। ফলে বল্লাল সেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গো হন্তাকে খোঁজে বের করার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করেন। বল্লালী নির্যাতনের ভয়ে উক্ত গোহন্তা বিক্রমপুর থেকে পালিয়ে গিয়ে মক্কায় হাজির হন।
তখন মক্কায় বাবা আদম নামক এক ধর্মান্ধ জবরদস্ত ফকীর ছিলেন। উক্ত ব্যক্তি বল্লালী নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য বাবা আদমের শরনাপন্ন হন। পৌত্তলিক বল্লাল কর্তৃক মুসলিম নির্যাতনের কাহিনী দরবেশকে আদ্যোপান্ত বলেন। বিক্রমপুরে বল্লাল রাজার অধীনতা থেকে তাদেরকে উদ্ধার করবেনই করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিমিষে ৭ (সাত) হাজার সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং এই সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি মক্কা থেকে বিক্রমপুর অভিমুখে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেন। পথে পথে অনেক যুদ্ধ জয়ের পর অবশেষে তিনি এবং তার সৈন্য বাহিনী বল্লাল রাজার রাজধানী রামপালের উপকন্ঠে দরগাবাড়িতে এসে ঘাঁটি গাড়েন। এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের নামে মসজিদটি নামকরণ করেন বাবা আদমের মসজিদ। এই মসজিদটিকে কেন্দ্র করেই বাব আদম ইসলামী আচার অনুষ্ঠান প্রকাশ্যেই পালন করা শুরু করেন। অনেক ষাঁড় ও গাভী জবে হ করা হতে থাকে। আজান দিয়ে নামাজ পড়া শুরু হয়। এই আজানের শব্দ বল্লাল সেনের রাজপ্রসাদের অভ্যন্তর ভাগেও গিয়ে পৌঁছে। এতে বল্লাল ক্রুদ্ধ হয়ে নবাগত মুসলিম সৈন্যবাহিনীর নেতা বাবা আদমের কাছে কয়েকটি দাবী রেখে দূত পাঠান। দূত এসে বাবা আদমকে বলেন, “হয় বিক্রমপুর ছেড়ে চলে যাও নয় পৌত্তলিকতা বিরোধী আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন থেকে বিরত হও।” কিন্তু অলৈকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দরবেশ বাবা আদম এতে দমাবার পত্র নন। তিনি তার অসংখ্য ভক্তের সমর্থনে নিশ্চিত হয়ে পরাক্রমশালী বল−াল সেনের কাছে এক ঔদ্ধত্বপূর্ণ উত্তর পাঠালেন। তিনি বললেন, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ (দঃ) তার রসূল। পৌত্তলিক বল্লাল রাজা যাই বলুন না কেন আর যাই করুন না কেন আমি এবং আমার সমর্থন আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন থেকে এক চুল পরিমাণও বিরত হব না”। এহেন ঔদ্ধত্বপূর্ণ উত্তরে বাধ্য হয়েই বল−াল সেন সৈন্য সংগ্রহ করে বাবা আদমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করলেন। তবে পূর্ব থেকেই বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুসলিম সৈন্য বাহিনীর বিজয় ও পরাক্রমের কাহিনী m¤^‡Ü অবহিত থাকাতে পরাজিত হলে যাতে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে মানসম্ভ্রম খোয়াতে না হয় সে জন্য তিনি আগেভাগেই ব্যবস্থা করে রেখে যান। তিনি সাথে করে একটি কবুতর নিয়ে যান এবং বলে যান যে, পায়রাটি একা রাজপুরীতে ফিরে এলে রানী এবং রাজপরিবারের অপরাপর সদস্যগণ যেন মনে করেন যে রাজা যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছেন। আর তারাও যেন জাতিধর্ম রক্ষার জন্য অমনি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন দেন। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব থেকেই রাজপুরীতে একটি অগ্নিকুন্ড প্রজ্বলিত ছিল। রাজধানী রামপালের মাইল দুই দূরবর্তী কানাইচঙ্গের মাঠে প্রত্যুষকালে থেকে তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। বল−াল সেন বাবা আদমকে নিহত করেন। বল−াল যুদ্ধে জয়ী হয়ে রক্তমাখা দেহ ধোয়ার জন্য যেই পার্শ্ববর্তী জলাশয় “কাঁছারীর দীধিতে” অবতরণ করেন অমনি দৈবক্রমে পায়রাটি বস্ত্রাভ্যন্তরে থেকে উড়ে গিয়ে রাজপুরীতে পৌঁছে। আর তক্ষুণি রাণী ও রাজপরিবারের অপরাপর সদস্যবৃন্দ ও রাজার পরাজয় ও মৃত্যু আশঙ্কা করে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন দিলেন। এদিকে বল্লাল সেনও পায়রা ছুটে যাওয়া মাত্রই যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পাগলের মতো রাজধানী রামপাল অভিমুখে ছুটে এলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে সবাই শেষ হয়ে গেছে। এই শোক সহ্য করতে না পেরে রাজও ঐ একই চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহুতি দিলেন। ফলে বিক্রমপুর মোসলমানদের করতলগত হল। শহীদ দরবেশ বাবা আদমকে সমাহিত করা হল তৎকর্তৃক নির্মিত মসজিদের গজ কয়েক পূর্বে। তখন থেকেই মসজিদটির নাম হল বাবা আদমের মসজিদ(Baba Adam Masjid) আর সমাধিটির নাম হল বাবা আদমের দরগা।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপালে হযরত বাবা আদম শহীদ (র.) এর মাজার সংলঘ্ন মসজিদ অবস্থিত। সড়কপথে ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের দূরুত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। তবে এই মাজারে আসার জন্য আরো ০৫ (প্রায়) কিলোমিটার ভিতরে আসতে হবে। ঢাকা হতে সকালে এসে মাজার জিয়ারত ও মসজিদ দর্শন করে বিকেলেই ঢাকায় ফিরে আসা যাবে। সড়কপথে যেতে কষ্ট হবে না। তবে নৌপথে গেলে সময়ও বাচঁবে এবং যানজট এড়িয়ে নদী পথের সৌন্দর্য অবগাহন করে স্বাচ্ছন্দের সাথে পৌছানো যাবে। সদর ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জ গামী লঞ্চে ২ ঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাওয়া যাবে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা হইতে রিক্সায় দরগাবাড়ি হযরত বাবা আদম শহীদ (র.) এর মাজার সংলঘ্ন মসজিদ এ যাওয়া যায়। ভাড়া ২৫-৩০ টাকা।