লালদিঘি নয় গম্বুজ মসজিদ(Noy Gmbuj Mosjid) বা লালদিঘি মসজিদ রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মসজিদটি বদরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘি নামক স্থানে অবস্থিত বলে একে স্থানের নামেই নামকরণ করা হয়েছে।
একটি বিরল রীতির মুগল মসজিদ। রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র লালদিঘিতে এটি অবস্থিত। খোলাহাটি রেলস্টেশন থেকে উত্তরে প্রায় ৬ কি.মি দূরে এর অবস্থান। ইমারতটি এক সময় গভীর জঙ্গলের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে এটি আবিষ্কৃত হয়। তখন থেকে এখানে নিয়মিত নামায আদায় করা হয়। স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে কিছু সংস্কারের পর বর্তমানে এটি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে।
লালদিঘি মসজিদ, রংপুর
পূর্বদিকে সংস্কারকৃত একটি প্রবেশতোরণ বিশিষ্ট প্রাঙ্গণের ভেতরে অবস্থিত প্রায় ১মি উঁচু একটি বাঁধানো ভিত্তি মঞ্চের (Plinth) পশ্চিম অর্ধাংশ জুড়ে মসজিদটির অবস্থান। মসজিদের সামনে ভিত্তি মঞ্চের উন্মুক্ত অঙ্গনে পৌঁছানোর জন্য পূর্বদিকে রয়েছে একটি মাত্র সিঁড়ি। এই অঙ্গনের উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে ধাপবিশিষ্ট একটি প্লাটফর্ম। এটি সম্ভবত আযান দেওয়ার কাজে ব্যবহূত হতো। মসজিদের সামনে রয়েছে বাঁধানো ঘাটবিশিষ্ট একটি বড় পুকুর। মূল মসজিদটি সম্পূর্ণ ইট দিয়ে তৈরী এবং চুন-সুরকির পলেস্তারা দিয়ে মসৃণভাবে আবৃত। এটি একটি বর্গাকার বহু গম্বুজবিশিষ্ট ইমারত। বাইরে থেকে প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৯.৪৫ মি। এর পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। এরমধ্যে মাঝেরটি দুপাশের দুটির তুলনায় বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালেও অনুরূপ তিনটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। এর মধ্যে মাঝেরটি পার্শ্ববর্তী অন্য দুটির চেয়ে বড়। উচ্চতা ও প্রশস্ততায় উত্তর ও দক্ষিণ পাশের মধ্যবর্তী দরজা দুটি পূর্বদিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটির সমান। দুপাশের অন্য দুটি উন্মুক্ত অংশ জানালা ও ইটের তৈরী জালি (Grille) দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর কিবলা দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধ অষ্টকোণাকৃতির মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড়।
ভূমি নকশা, লালদিঘি মসজিদ
সবগুলি মিহরাব এবং প্রবেশপথেই রয়েছে বহুখাঁজ বিশিষ্ট খিলান। মসজিদের পাঁচটি প্রবেশদ্বারই উন্মুক্ত হয়েছে একটি করে অর্ধগম্বুজাকৃতির খিলান ছাদের (Vault) নিচে। উপমহাদেশের মুগল স্থাপত্যে এই রীতিটি একটি অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মসজিদের চার দেওয়ালেরই মাঝে রয়েছে দেওয়াল থেকে সামান্য বহির্গত একটি করে প্রক্ষেপণ। পশ্চিম দিকের কেন্দ্রীয় মিহরাব এবং বাকি তিন দিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথসমূহকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে এই প্রক্ষেপণ। এই চারটি প্রক্ষেপণেরই দুপ্রান্তে রয়েছে সরু অলঙ্কৃত মিনার (Turret)। এগুলি ছাদের অনুভূমিক প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং এর শীর্ষে রয়েছে কলস নকশার শীর্ষচূড়াশোভিত ছোট ছোট গম্বুজ। মসজিদের চারকোণের বাইরের দিকে রয়েছে বৃত্তাকার পার্শ্ববুরুজ। এগুলিও প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। বুরুজগুলির ভিত্তিতে রয়েছে কলস নকশার শীর্ষচূড়াশোভিত ক্ষুদ্রাকৃতির খাঁজকাটা গম্বুজ। মসজিদের ভেতরে স্থাপিত দুই সারিতে দুটি করে মোট চারটি ইটের তৈরী স্তম্ভের সাহায্যে এর অভ্যন্তরভাগকে তিনটি ‘আইল’ এবং তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ মসজিদের অভ্যন্তরভাগ নয়টি আলাদা বর্গাকার ’বে’তে বিভক্ত। এগুলির প্রতিটির উপরে আচ্ছাদন হিসেবে রয়েছে একটি করে গম্বুজ। গম্বুজগুলির আকৃতি সামান্য কন্দাকার (Bulbous)। অভ্যন্তরের চারটি স্তম্ভ এবং প্রতি দেওয়ালে দুটি করে মোট আটটি সংলগ্ন স্তম্ভের উপর থেকে নির্মিত পরস্পরভেদী খিলান গম্বুজগুলির ভার বহন করছে। গম্বুজ নির্মাণে অবস্থান্তর পর্যায়ে ব্যবহূত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাংলা পেন্ডেন্টিভ।
পর পর কৌণিক এবং প্রান্তীয়ভাবে সজ্জিত ইটের সাহায্যে এখানে মৌচাক নকশার (Honey comb) একটি সরল অথচ সুন্দর রূপ তুলে ধরা হয়েছে। সবগুলি গম্বুজই সরাসরি অষ্টভুজাকৃতির পিপার (Drum) উপর স্থাপিত। আর এগুলির শীর্ষে রয়েছে পদ্ম এবং কলস নকশাশোভিত শীর্ষচূড়া। অভ্যন্তরে ইট নির্মিত স্বতন্ত্র স্তম্ভগুলি বিশাল আকৃতির এবং বহু বাহুবিশিষ্ট। এগুলির ভিত্তিতে রয়েছে কলস নকশা, আর নিচ থেকে উপরের দিকে এগুলি ক্রমহ্রাসমান।
পুরো ইমারতটির ভেতরের ও বাইরের দেওয়াল চুন সুরকির পলেস্তারা দিয়ে মসৃণভাবে আবৃত। কিবলা দেওয়াল ব্যতীত বাকি তিন দেওয়ালের বাইরের অংশ এই পলেস্তারা দিয়ে তৈরী ছোট ছোট আয়তাকার খোপ-নকশা দিয়ে অলঙ্কৃত। ইমারতের পুরো বিস্তার জুড়ে রয়েছে পলেস্তারার প্যাঁচানো নকশায় অলঙ্কৃত একটি অনুভূমিক কার্নিশের ব্যান্ড। আর এর বপ্র জুড়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বদ্ধ পদ্মপাপড়ি নকশার সারি। গম্বুজসমূহের পিপার বাইরের অংশ এবং পার্শ্ববুরুজগুলির ওপরের ছত্রীর ভিত্তিও অনুরূপ পদ্মপাপড়ি নকশা দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে।
সবগুলি মিহরাবই এক সময় অলঙ্করণে সমৃদ্ধ ছিল। বর্তমানে সেসব অবশ্য অনেকাংশে হারিয়ে গেছে। মিহরাবের কুলুঙ্গির উপরের অর্ধগম্বুজ খিলান ছাদে এখন রয়েছে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম-নকশার অর্ধাংশ, আর মিহরাবের উপরে স্থাপিত ব্যান্ডে রয়েছে বদ্ধ পদ্মপাপড়ি নকশার সারি। গম্বুজগুলির ভিত্তির ভেতরের অংশে এক সময় নিশ্চয়ই গভীর খিলানের নকশা ছিল, কেন্দ্রীয় গম্বুজটিতে যার চিহ্ন এখনও দেখা যায়। এগুলির শীর্ষে রয়েছে বড় আকারে একটি বৃত্তাকার নকশা, আর এই বৃত্তের কেন্দ্রে পলেস্তারা দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত (Interlocking) নকশা উৎকীর্ণ হয়েছে।
মসজিদটির পূর্ব ফাসাদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উপর এক সময় একটি শিলালিপি ছিল। বর্তমানে সেটি হারিয়ে যাওয়ায় এ মসজিদের নির্মাণকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। লালদিঘির আশেপাশে প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী জনৈক দিলওয়ার খান এ মসজিদের নির্মাতা। এই দিলওয়ার খানের পরিচয় এখনও জানা যায় নি। তবে এই মসজিদের অনেক স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য মুগল আমলে নির্মিত কিশোরগঞ্জের গোরাই মসজিদ (আনুমানিক ১৩৮০), বাগেরহাটের চাকশ্রী মসজিদ (আনুমানিক সতেরো শতকের শেষভাগ), বগুড়ার ফররুখ সিয়ার মসজিদ (১৭১৮) প্রভৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য বিচারে এই মসজিদের নির্মাণকাল সতেরো শতকের শেষভাগ অথবা আঠারো শতকের প্রথমভাগে নির্ধারণ করা যায়।
নয় শতকের গোড়া থেকেই এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম দেশে নয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ পরিকল্পনা জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তখন থেকেই এই পরিকল্পনাবিশিষ্ট মসজিদ নির্মিত হয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত জ্ঞাত ইমারতসমূহের মধ্যে আফগানিস্তানের বলখ শহরে অবস্থিত মসজিদ-ই তারিখ (৮০০-৫০) সর্বপ্রাচীন নয়গম্বুজ মসজিদ। এরকম আরও কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে সুসার বু ফাতাতা মসজিদ (আনুমানিক ৮৪০), কায়রোর শরীফ তাবাতাবা মসজিদ (আনুমানিক ৯৫০), টলেডোর বিবি মারদুম মসজিদ (আনুমানিক এগারো শতকের শেষ ভাগ), এসকি জামি মসজিদ (১৪০৪-১৪) প্রভৃতি।
বাংলায় নয়গম্বুজ মসজিদের মধ্যে বাগেরহাটের নয়গম্বুজ মসজিদ, বরিশালের গৌরনদীতে অবস্থিত কসবা মসজিদ, খুলনার আমাদিতে অবস্থিত মসজিদকুর মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ সবগুলিই প্রাক মুগল আমলে নির্মিত। লালদিঘি মসজিদই সমগ্র মুগল ভারতে নয়গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকার মসজিদের একমাত্র জ্ঞাত নিদর্শন। সুলতানি বাংলায় এই রীতিটি বেশ জনপ্রিয় ছিল এবং বাংলার সুলতানদের পতনের দীর্ঘকাল পরেও এখানে তা পুনর্বার অনুসরণ করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র : https://goo.gl/v2HgVy