টাংগুয়ার হাওর(Tanguar haor) বাংলাদেশের সবছেয়ে বৃহৎ জলাশয়। মাছ ,বন, পাখী,জীববৈচিত্র,নির্মল বায়ূ,উন্মুক্ত আকাশ,মেঘালয় এর পাহাড় শ্রেণীর অপরূপ সৈন্দর্য এ গুলিই টাংগুয়ার হাওরের বিশেষ বৈশিষ্ট। জলাশয় গুলি যেন ছোট ছোট সমুদ্র্ । ঢেউ নেই , প্রশান্ত শলীল ,সব মিলিয়ে সৈন্দর্যের এক প্রাকৃতিক আধার। পাশে টেকের ঘাট এবং লাউড়ের গড় পাহাড় কন্যা মেঘলয়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা জনপদ,যাদু কাটা নদী একটি প্রাকৃতিক সুইমিং পুল,বারিকিয়ার টিলা সুন্দর একটি পিকনিক স্পট,সব মিলিয়ে এক অংগে এত রূপ যেন ।
বিশাল এই জলাভূমিতে প্রকৃতি বেড়ে উঠেছে আপন খেয়ালে। আর তার যে সৌন্দর্য, চোখে না দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৮ মৌজায়, ৫১টি জলমহালের সমন্বয়ে নয় হাজার ৭২৭ হেক্টর অঞ্চল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর গড়ে উঠেছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলাভূমি। বর্ষাকালে হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর।
ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই টাঙ্গুয়ার হাওর। মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝরনা এসে সরাসরি মিশেছে হাওরের পানিতে। সারিসারি হিজল-করচশোভিত, পাখিদের কলকাকলি সদা মুখরিত টাংগুয়ার হাওর। এটি মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুনাম শুধু সুনামগঞ্জ বা বাংলাদেশে নয়, বাইরেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওরকে বলা হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চল। সুন্দরবনকে ধরা হয় প্রথম। (ইরানের রামসার অঞ্চলে প্রথম জলাভূমি শনাক্ত করার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখান থেকেই এই নামটি এসেছে।)
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশ মুখেই দেখা যায় সারিসারি হিজলগাছ। দেখে মনে হবে এই গাছগুলো হাওরে আগত অতিথিদের অভিবাদন জানানোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। মূল হাওরে প্রবেশ করলে হাওরের পানিতে নিচের দিকে তাকালে দেখা মিলবে হরেক রকম লতাপাতাজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। দেখে মনে হবে পানির নিচে অপরূপ সবুজের স্বর্গরাজ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে আরো পাবেন করচ, বরুন, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসি, নলখাগড়া, বল্লুয়া ও চাল্লিয়া জাতের উদ্ভিদ।
বাংলাদেশের পাখির এক স্বর্গরাজ্যের নাম টাঙ্গুয়ার হাওর। শীতের শুরু থেকে শেষ অবধি এ হাওরে বসে পাখিদের মিলনমেলা। আর এসব পাখির বেশিরভাই পরিযায়ি। এখানে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে সম্ভবত পাখিদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফেব্রুয়ারি মাসে। পাখি দেখতে চাইলে টাঙ্গুয়ার হাওরে কমপক্ষে দুই দিন দুই রাতের একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন।
এ ছাড়া ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, বেশ কয়েক প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির কিছু উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বসবাস এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর।
আমাদের দেশীয় পাখিগুলো সারা বছরই খুনসুটি, জলকেলি আর খাবারের খোঁজে এক বিল থেকে আরেক বিলে ওড়াউড়ি করে মাতিয়ে রাখে এই হাওরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। আর শীত এলে আমাদের দেশি পাখির সাথে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করে টাঙ্গুয়ার হাওরে। এতে হাওয়ার শোভা বেড়ে যায় কয়েকশ গুণ।
প্রতিবছর নভেম্বর মাসের শুরুতেই সুদূর সাইবেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসে অতিথি পাখি। শীতের তীব্রতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নানা প্রজাতির এসব অতিথি পাখি আসে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায়। সেখানে তারা গড়ে তোলে ক্ষণস্থায়ী আবাস। তার মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর অন্যতম। পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল, পাতিকুটসহ নানা প্রজাতির পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, যা আমাদের দেশে কুড়া ঈগল নামে পরিচিত, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। পাখি বিশেষজ্ঞরা টাংগুয়ার হাওরে বিরল কিছু পাখির সন্ধান পেয়েছেন কয়েক বছর আগেই। এসব বিরল পাখির মধ্যে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড (লাল ঝুটি), পিন টেনল (ল্যাঞ্জা হাঁস), সভেলার (খুন্তে হাঁস), মালার্ড (নীলমাথা হাঁস), গাডওয়াল (পিয়াং হাঁস), ঠাফটেউ (টিকিহাঁস), কঁনপিগমি (ধলা বালিহাঁস), বেগুনি কালেম, পান মুরগি, সরালি, রাজসরালি, পাতিমাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা ও চখাচখি উল্লেখযোগ্য।
টাঙ্গুয়ার হাওর হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি মিঠাপানির মাদার ফিশারিজ। স্থানীয়ভাবে ছয়কুড়ি কান্দা আর নয় কুড়ি বিল নামে পরিচিত এই বিশাল জলাভূমি শুধু পাখি নয়, মাছের জন্যও বিখ্যাত। একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ ছিল। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটি প্রজাতি পাওয়া যেত এই হাওরে। এ ছাড়া রয়েছে গাং বাইম, কালবাউশ, তারা বাইম, বাইম, গুতুম, গুলশা, টেংরা, তিতনা, গইন্না, রুই, কাতল, চিতল, বোয়ালসহ আরো নানা প্রজাতির দেশি মাছ।
টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশের মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি করা। টাঙ্গুয়ার হাওরে মা মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়বে আর বর্ষাকালে এই মাছগুলো ছড়িয়ে পড়বে দেশের অন্যান্য নদীনালা ও খালবিলে। সেজন্য টাঙ্গুয়ার হাওরের ইজারা প্রথা বিলোপ করে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়।
কোথায় থাকবেন
বেসরকারী ব্যবস্থায়পনায় সেখানে রাত্রি যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই তবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ৩ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজে অবস্থান করা যায়। হাওর ঘুরে রাতটা তাহিরপুর থানার ডাকবাংলোতে ও থাকতে পার এছাড়া তাহিরপুরে থাকার তেমন ভালো হোটেল নাই। তাহিরপুরের কাছে বাদাঘাটে একটা হোটেল পাবেন-বোর্ডিং থেকে উন্নত মানের, বাদাঘাটে খাবার হোটেল ও আছে অনেক। বাদাঘাট থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে কষ্ট হবে কিন্তু অন্যান্য স্থানে যাওয়া সহজ(শুধু মটর সাইকেল চলে)। বাদাঘাটে তারক হোটেল নামে একটা হোটেল আছে । ডাবল বেড রুম ৪০০-র মত।
কিভাবে যাবেনঃ
প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন, মামুন পরিবহনের নন এসি বাস যায় সুনামগঞ্জ। ভাড়া এসি ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা।
সুনামগঞ্জ শহরের আগে শুরমা সেতু থেকে লেগুনা কিংবা মোটরবাইকে যেতে হবে তাহিরপুর কিংবা সোলেমানপুর। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে সোলেমানপুর যাওয়াই উত্তম। কারণ তাহিরপুর থেকে সোলেমানপুরের বৌলাই নদীতে এ সময়ে নাব্যতা কমে যায়।
সুনামগঞ্জ থেকে সোলেমানপুর যেতে একটি লেগুনার ভাড়া পড়বে ৮শ’ থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা। যাওয়া যাবে কমপক্ষে আটজন।
মোটরবাইকে দু’জনের খরচ পড়বে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। সোলেমানপুর থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে পাতলাই নদী ধরে যেতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
সেখানে বিভিন্ন রকম ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। প্রতিদিনের জন্য একটি নৌকার ভাড়া পড়বে ১ হাজার ২ হাজার ৫শ’ টাকা। এসব নৌকায় রাতেও থাকা যাবে।
বর্ষাকালে শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পীড বোট যোগে সরাসরি টাঙ্গুয়া যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘন্টায় এবং স্পীড বোটে ২ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ইঞ্জিন বোটে খরচ হয় ২,০০০/- থেকে ২,৫০০/- টাকা পক্ষান্তরে স্পীড বোডে খরচ হয় ৭,৫০০/- থেকে ৮,০০০/- টাকা।
গ্রীষ্মকালে শহরের সাহেব বাড়ি খেয়া ঘাট পার হয়ে অপর পার থেকে প্রথমে মোটর সাইকেল যোগে ২ ঘন্টায় শ্রীপুর বাজার/ডাম্পের বাজার যেতে হয়। ভাড়া ২০০ টাকা। সেখান থেকে ভাড়াটে নৌকায় টাঙ্গুয়া ঘরে আসা যা সেয়।ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ ব্যয় হতে পারে ৩০০-৪০০/- টাকা।
তথ্যসূত্রঃ https://goo.gl/iXRnki
ভাল লিখছেন। এটা পড়ে ফেলতে পারেন।