শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে আসা অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর ভোলার উপকূলীয় চরাঞ্চলগুলো। হেমন্ত শেষে শীতের হিমেল হাওয়া শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জীবন বাঁচাতে অতিথি পাখির দল ঝাঁক বেঁধে হাজির হয় এ অঞ্চলে।
শীতের সকাল-বিকেল অতিথি পাখিদের কিচিরমিচির, উড়ে বেড়ানো আর জলকেলি ছুঁয়ে যায় মানুষের মন। চর কুকরিমুকরি(Char Cookie-Muqri) ও ঢালচরের ম্যানগ্রোভ বাগান পেরিয়ে দক্ষিণে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ছুটাছুটি দেখলে মনে হবে এ যেন পাখির রাজ্য। হাজার হাজার পাখি কখনও ডানামেলে উড়ছে। আবার কখনও ঝাঁকে ঝাঁকে নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে।
দ্বীপজেলা ভোলার চারদিকে ঘিরে থাকা মেঘনা-তেঁতুলিয়া বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা ডুবোচরগুলো বিচরণের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে অতিথি পাখির দল।
নভেম্বরে আসা শুরু হয় তাদের। গ্রীষ্মের তাপ শুরু হলে এসব পাখির দল ফিরে যায় পুরনো ঠিকানায়। সে হিসাবে আর কয়েক দিনের মধ্যে আপন কুলায় ফিরবে পরিযায়ী এ পাখির দল। শীত মৌসুমে বাংলাদেশে আসা অতিথি পাখির অর্ধেক আসে ভোলা উপকূলে। অতিথিপরায়ণ বাঙালি আদর করেই ভিনদেশি এ পাখিকে অতিথি পাখি নামে ডাকে।
সম্প্রতি শুমারি শেষে গত ২৬ জানুয়ারি দলের প্রধান ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক জানান, ২০১২ সালের শুমারিতে ভোলা উপকূলে ৬৫ জাতের প্রায় ২২ হাজার ৮৪৯টি পাখি এসেছে। ২০১৩ সালের শুমারিতে প্রায় ৬৪ প্রজাতির ৩৫ হাজার ৫০০টি জলচর পাখি দেখা গেছে। এ বছর তা বেড়ে ৬৬ প্রজাতির প্রায় ৪৯ হাজার ৯২৫টি পাখি দেখেছেন পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের নেতৃত্বাধীন শুমারি দল।
এবার প্রথম দেখা গেছে প্রায় বিপন্ন ‘চামচ ঠুঁটো বাটান’ নামের জলচর ও মদনটাক নামের বিপন্ন পাখি। এবার জলচর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি বাড়লেও এদের প্রজনন, খাদ্যস্থল ও বিচরণক্ষেত্র নিয়ে শঙ্কিত শুমারি দল। জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় জেগে ওঠে এমন চরগুলোই অতিথি পাখিদের মুক্ত বিচরণ ভূমি।
ভোলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা চর কুকরিমুকরি, চর শাহজালাল, চর শাজাহান, চর পিয়াল, আইলউদ্দিন চর, চর নিজাম, দমার চর, ডেগরারচরসহ পাঁচ শতাধিক এমন ডুবোচর রয়েছে। ওইসব চর থেকেই পাখিরা তাদের খাবার সংগ্রহ করে। বড় কোনো বিপদে পড়লে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী ম্যানগ্রোভ বনে।
এদিকে পাখির প্রধান আশ্রয়স্থল উপকূলের অনেক চরাঞ্চলে মানুষের বসবাস শুরু হওয়ায় নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে না। একটি বিশেষ শ্রেণীর শিকারি কারেন্ট জালের ফাঁদ পেতে আর বিষ প্রয়োগ করে অতিথি পাখি নিধন করছে।
জেলা শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরের মেঘনার মধ্যবর্তী মদনপুর ও মধুপুর চরে প্রতি বছরের মতো এবারও পাখি নিধনের খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ নেচার কনজারভেশন কমিটির (এনসিসি) জেলা সমন্বয়কারী জসিম জনি জানান, ভোলা অঞ্চলে যেসব পাখি বেশি দেখা যায় সেগুলো হলো_ কমন শেল ডাক, রাডি শেল ডাক, লেসার উইস্টলিংক ডাক, মেলাড, পসার্ড, পিন টেইল ডাক, কটন টিল, কমন পসাড, টাপটেড ডাক, কমনস্যাং পাইপার, উড স্যাং পাইপার, গ্রিন স্যাং পাইপার, কারলিউ, উইমরেল, স্ন্যাইপ, গডওয়াল, বার-হেডেড গুস, সুভেলার, স্পুন-বিল স্যাং পাইপার, স্কিমার, আইবিচ, পভার, লেপউইং, গার্ল প্রভৃতি জলচর অতিথি পাখি।
দেশে যে পরিমাণ অতিথি পাখি আসে তার প্রায় অর্ধেকই ভোলার চরাঞ্চলে অবস্থান করে। পাখির মুক্ত বিচরণ এলাকাগুলোতে মানুষ বসবাস শুরু করায় পাখি আসা কমে যাচ্ছে বলে জানান এনসিসির আঞ্চলিক সমন্বয়কারী।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভোলার উপকূলীয় এলাকায় অতিথি পাখি নিরাপদে আছে দাবি করে চর কুকরিমুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন জানান, পাখি শিকার থেকে বিরত থাকার জন্য এলাকায় মাইকিংসহ প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া শৌখিন শিকারিদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
ভোলা অঞ্চলে আসা অতিথি পাখিরা নিরাপদে আছে দাবি করে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রুহুল আমিন জানান, অতিথি পাখির শিকার বন্ধ করা ও অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে এলাকাভিত্তিক ৭টি টহল দল গঠন করেছে বন বিভাগ। টহল দলগুলো নিয়মিত টহলের মাধ্যমে পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। লঞ্চ ও ট্রলার ঘাটগুলোয় পাহারা বসানো আছে।
এ ছাড়া জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোস্টগার্ড বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী আশির দশকে ভোলায় ৩৫০ প্রজাতির পাখি দেখা যেত, বর্তমানে এর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৬-তে। পাখির বিচরণক্ষেত্র ও নিরাপদ প্রজননে বাধা এবং খাদ্যস্থল মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় পাখির সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
কিভাবে যাবেন
জেলা শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরের মেঘনার মধ্যবর্তী মদনপুর ও মধুপুর