মেহেরপুর মানেই নীলকরদের ইতিহাস ও অত্যাচারের কাহিনি। এদেশে ব্রটিশ রাজত্বকালে ইংরেজরা সে সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে নীল চাষ করার জন্য যে সব কুঠি গড়ে তুলে ছিলেন, সেসব কুঠিবাড়িই নীলকুঠি নামে পরিচিত। কুষ্টিয়া মেহেরপুর সড়ক বা ঢাকা মেহেরপুর সড়কের কাছেই আমঝুপি নীলকুঠির অবস্থান (Amjhupi Neelkuthi)।
মোঘল সেনাপতি মানসিংহ এবং নবাব আলীবর্দি খাঁর স্মৃতি বিজোড়িত এই আমঝুপিতেই পলাশীর পরাজয়ের নীলনকশা রচিত হয়েছিল। কথিত আছে এই নীলকুঠিই ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ লয়েড ও মীলজাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের শেষ বৈঠক হয়েছিল। যার পরের গল্প অত্যাচার আর নির্যাতনের।
আমঝুপি ষড়যন্ত্রের ফলাফল সিরাজ-উদ-দৌলার পতন। ফলাফল বাঙালিদের স্বাধিনতা হারিয়ে পরাধীনতা গ্রহণ। তারপর সেই যে অত্যাচার শুরু হল সেই অত্যাচারের রক্তেই একদিন এখানে আমঝুপিতে নীলকুঠি গড়ে উঠল।
আমঝুপি নীলকুঠিতে দেশীয় স্থাপত্যের সাথে ইউরোপীয় স্থাপত্য বিশেষ করে ব্রিটিশ স্থাপত্যেরীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। মূল কুঠি ভবনের বহির্বিভাগ দেখে এর সামগ্রিক অবস্থা অনুধাবন সম্ভব নয়। ভবনটির বাইরে চাকচিক্য না থাকলেও বিবর্ণরুপ পরিগ্রহ করেনি।
কুঠিভবনটির দৈর্ঘ ১৫ মিটার, প্রস্থ ১০ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার। এতে রয়েছে দুটি প্রবেশ পথ ও ১৮টি জানালা। আমঝুপি কুঠিবাড়ির পূর্বদিকে রয়েছে একটি মনোরম ফুলের বাগান। এছাড়া তহসিল অফিসের সামনে রয়েছে একটি পেয়ারা বাগান। কুঠিবাড়ির আম্রকাননের পাশাপাশি রয়েছে ইংরেজ আমলে লাগানো বেশ কিছু নাম না জানা বিশাল আকৃতির গাছ। দক্ষিণ দিকে কাজলা নদীর কোল ঘেঁষে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে নারিকেল গাছ। এসব গাছ ও বাগানের মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশ কুঠিবাড়ির স্থাপত্যে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা, যা আমঝুপি নীলকুঠির নিথর পরিবেশকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত।
ভবনটিতে প্রবেশের দুটি পথ আছে। মূল প্রবেশ পথ এবং ভবনের সম্মুখ ভাগ কাজলা নদীর দিকে। কারন তৎকালে নদী পথেই চলত সকল যোগাযোগ। তাছাড়া জানা যায় নীলকরদের নৌযান এসে এখানেই থামতো। ঢুকতো এ পথ দিয়েই। নদীর মাঝ থেকে একটি শান বাধানো সিড়ি উঠে এসেছে মূল ভবনের সম্মুখ ভাগের বাগানে। এটি তৎকালে কাঠ দ্বারা নির্মিত ছিল। এ বাগানের ভিতর দিয়ে ভবনটির বারান্দায় উঠতে হয়। এটিই ভবনটির প্রধান প্রবেশ পথ।
নীলকুঠিতে ছোট-বড় মোট পনেরটি কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষ ব্যবহৃত হতো বৈঠকখানা, সংগীত, নৃত্যগীত এবং আমোদ-প্রমোদ করার জন্য। এর সাথে রয়েছে চারটি সাজঘর ও পরিচারকদের কোয়ার্টার। পশ্চিম দিকে অবস্থিত পরিচারকদের ও সাহায্যকারীদের বসবাসের দালান যা বর্তমানে কুঠিবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ও তত্বাবধায়কের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভেতরে মস্ত বড় একটা হল ঘর। নীলকুঠির কক্ষগুলোর মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ। কাঠের মেঝে যুক্ত অর্ধগোলাকার এই কক্ষের এক কোনায় একটা ফায়ার প্লেস। কক্ষটির সামনের দেয়ালের উপরিভাগে টাঙানো বড় একটি মহিষের মাথা। এর দুপাশে আরো অনেকগুলো ঘর। এর কোনটিতে বসত নাচের আসর। কোনটায় ঝাড়বাতির আলোর নীচে লুন্ঠিত হত বাঙ্গালী নারীর সতীত্ব। কোনটাতে চলতো নীলচাষীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন। জানা যায় এটি ছিল জলসা ঘর।
কুঠিবাড়ির ভেতরে আজও রয়ে গেছে ইংরেজদের ব্যবহার করা চেয়ার, টেবিল, খাট, মহিষের শিং ইত্যাদি। ঘরগুলোর মেঝে অত্যন্ত মসৃন। কয়েক শতাব্দী আগের বানানো এ মেঝের মসৃণতা এ যুগেও বিস্ময়কর। কাজলা নদীর ওপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত সেতু, শানবাধানো বসার আসনবেষ্টিত ঘাট নিঃসন্দেহে এই কুঠির সবচে চিত্তাকর্ষক ও ব্যাতিক্রমী বৈশিষ্ট্য।
মেহেরপুর থাকার জন্য মিতা/ কামাল/ ফিন টাওয়ারসহ ভালো কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। এ ছাড়া থাকার ব্যবস্থা করা যাবে জেলা সার্কিট হাউস ও পৌর হলে। এ ক্ষেত্রে আগে থেকেই থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে যেতে হবে।
মেহেরপুর বেড়ানোর জন্য এখানকার স্থানীয়ভাবে নির্মিত পরিবহন ‘আলম সাধু’ দারুণ জনপ্রিয়। ইঞ্জিনচালিত বড় ধরনের ভ্যানগাড়ি বা ভটভটিকে এখানে বলা হয় ‘আলম সাধু’। মেহেরপুরে খাবারের ব্যবস্থা ভালো। আর এখানকার দই ও মিষ্টির স্বাদ অপূর্ব। মেহেরপুরে আমঝুপি ছাড়াও আছে ভাটপাড়া ও সাহারাবাটি নীলকুঠি। এ ছাড়া আমদহ স্থাপত্য নিদর্শন, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির ও ভবানন্দপুর মন্দির ঘুরে আসা যেতে পারে।
কীভাবে যাবেন
আমঝুপি নীলকুঠি দেখতে মুজিবনগর থেকেও মেহেরপুর যাওয়া যায়, আবার সরাসরি মেহেরপুর চলে যাওয়া যেতে পারে। মেহেরপুর সদর থেকে আমঝুপির দূরত্ব সাত কিলোমিটারের মতো। ঢাকা থেকে মেহেরপুর সরাসরি বাসে করে যাওয়া যেতে পারে।