মহেশখালী আদিনাথ মন্দির – কক্সবাজার

চর্তুদিকে সাগর বেষ্টিত মহেশখালী দ্বীপের অন্যতম দর্শনীয় স্থান আদিনাথ মন্দির(Adinath Mondir)। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৮৮ ফুট উঁচু মৈনাক পাহাড় চূঁড়ায় আদিনাথ মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১০.৮৭ মিটার, প্রস্থ ৮.৬২ মিটার, উচ্চতা ৫.৯৩ মিটার।

আদিনাথের গোড়াপত্তন কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে ত্রেতাযুগে। এর একটি ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, রামায়ণ, পুরাণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। ত্রেতাযুগে রাম-রাবণের যুদ্ধের কথা ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। রাবণ লঙ্কা যুদ্ধে রামের সঙ্গে জয়লাভের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অমরত্ব বর প্রার্থনা করেন। মহাদেব এসময় কৈলাসে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তিনি রাবণের আরধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অভীষ্ট সাধনে বর দান করেন এবং শর্ত দেন শিবরূপী উর্ধমুখী শিবলিঙ্গ কে কৈলাস হতে বহন করে লঙ্কায় নিয়ে যেতে হবে এবং পথিমধ্যে কোথাও রাখা যাবে না। যদি রাখা হয় তবে মহাদেব সেই স্থানেই অবস্থান নেবেন এবং রাবণের অভীষ্ট সাধন হবেনা। শর্তানুসারে রাবণ শিবলিঙ্গ বহন করে লঙ্কার উদ্দেশ্য গমন করেন তবে পথিমধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে বর্তমান মহেশখালীর মৈনাক পর্বতে থামতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে শর্তানুসারে রাবণ শিবলিঙ্গ পূনরায় উঠাতে ব্যর্থ হন এবং মহাদেব এই মৈনাক শিখরেই অবস্থান গ্রহণ করেন।

তিনভাগে বিভক্ত প্রথম ভাগে ৩.৩৫ মিটার বর্গাকৃতির দু’টো পূজা কক্ষ রয়েছে। পূর্বকক্ষে বাণলিঙ্গ শিবমূর্তি আর পশ্চিম কক্ষে অষ্টভূজা দূর্গা মূর্তি। শিবের সাথে মন্দিরে একটি গভীর সম্পর্ক বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে থাকেন। শিবকে রাবন কাঁধে করে কৈলাস পর্বত থেকে লংকার উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে শিব এ মৈনাক পাহাড়ে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন বলে তাদের বিশ্বাস। এছাড়া এলাকার প্রচলিত কিংবদন্তীমতে মহেশখালীর প্রভাবশালী জনৈক নুর মোহাম্মদ সিকদারের স্বপ্নের অলৌকিক নির্দেশমতে জানতে পারেন যে, স্বপ্নে দেখা শিলাখন্ডটি হিন্দুদের ‘দেববিগ্রহ’। এ দেব বিগ্রহের অনেকগুলো নামের মধ্যে ‘মহেশ’ ও ‘আদিনাথ’ নাম দু’টো অন্যতম। দেববিগ্রহের নামানুসারে দ্বীপের নাম মহেশখালী আর মন্ডপের নাম ‘আদিনাথ মন্দির’ নামকরণ বলে ধারণা করা হয়। সে যাই হোক এ মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বছর এখানে শিব চর্তুদশী মেলা আয়োজন করা হয়। শিব ভক্তের প্রভাবে মহেশখালীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান শারদীয় দূর্গোৎসব সাড়ম্বরভাবে উদ্যাপন করা হয় না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রচুর পূণ্যার্থী ও দর্শণার্থী এ উপলক্ষে মহেশখালীতে সমাগম ঘটে থাকে। ছেলেমেয়ে পাওয়ার জন্য কিংবা প্রাপ্ত ছেলেমেয়ের দীর্ঘায়ূর জন্য মানস করে থাকে বলে অনেক নারী-পুরুষকে মূল মন্দিরের অভ্যন্তরে পশুপাখি বলি দিতে দেখা যায়। এ সময়ে সনাতন ও রাখাইন ঘরে ঘরে আগত অতিথিদের সাধ্যমত আপ্যায়নের নিমিত্ত স্থানীয়রা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আদিনাথ মন্দিরের পাশে বৌদ্ধদের একটি প্রাচীন প্যাগোডা আছে

বর্তমানে প্রতিনিয়ত পাহাড় ভাংগনের কারণে মন্দিরের পূর্ব পাশের বিস্তর জমি সমুদ্রের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। এ মন্দিরের পাশেই কক্সবাজার জেলা পরিষদ কর্তৃক আদিনাথ জেটি সম্প্রতি নির্মিত হওয়ায় পর্যটকদের এখানে আগমন আরো সহজতর হয়েছে। আদিনাথ মন্দিরের পাদদেশে রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি পাড়া ও ঠাকুরতলা বৌদ্ধ বিহার নামে একটি বিহার রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাক হানাদারবাহিনী বৌদ্ধ বিহারটিতে অগ্নিসংযোগ পূর্বক নির্বিচারে গোলাবর্ষণে ৫ জন নিরীহ রাখাইন শহীদ হন। পাকদের নির্মম তান্ডবলীলার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখনো উক্ত বৌদ্ধ বিহারে গলাকাটা কয়েকটি শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি কালের নীরব সাক্ষী হিসেবে বর্তমান রয়েছে। আদিনাথ মন্দিরে আগত পর্যটকদের জন্য অস্থায়ীভাবে রাখাইন রমণীরা তাদের নির্মিত কাপড়, চাদর বিক্রয় করার জন্য পসরা সাজিয়ে রাখে। আদিনাথ মন্দিরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত মুদিরছড়ার সন্নিকটে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কক্সবাজারে আগত বৃটিশ মালিকানাধীন ‘এম.ভি ম্যালাড’ নামে এক জাহাজ ডুবিতে অনেক লোকের সলিল সমাধি ঘটে। সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও ছিল। হতভাগ্য যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন কক্সবাজার মহকুমায় সদ্য বদলী হয়ে আসা পরিবারবর্গসহ একজন ম্যাজিস্ট্রেট। প্রখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই সৈয়দ মোস্তফা আলীর মেয়ে ছিলেন হতভাগা ম্যাজিস্ট্রেটের সহধমির্ণী।

 

পূজো-অর্চনাঃ

প্রতিদিনই নিয়ম মোতাবেক আদিনাথ, অষ্টাভূজা, ভৈরব ও রাধা গোবিন্দ এর মন্দিরে একই সময়ে পূজো-অর্চনা হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতি বৎসর ফাল্গুনের শিব চতুর্দ্দশী তিথিতে পূজো-অর্চনা ও পক্ষকালব্যাপী মেলা হয়। এসময় পূণ্য সঞ্চয় ও মনস্কামনা পূরণার্থে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান হতে আগত তীর্থ যাত্রীদের পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকে। মন্দিরে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। ভক্তগণ প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করে গাছে সূতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সূতা খুলে পূজা অর্পণ করেন। মূল মন্দিরের পেছনের দিকে দুটি পুকুর রয়েছে।সুমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ২৮০ ফুট উচ্চতায় পুকুর দুটির অবস্থান হলেও এর জল কখনই শুকায় না। জনশ্রুতি রয়েছে দু্টি পুকুরের মধ্যে একটিতে স্নান করলে সকল রোগ দূর হয়।

 

মন্দিরের ব্যবস্থাপনাঃ

মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত বুকলেট হতে জানা যায় নবাব আলীবর্দি খাঁন, দেওয়ান ব্রজ কিশোর লাল কানুনগোর প্রতিনিধি দেওয়ান কালিচরণের নয় বৎসরের কিশোর শরৎ চন্দ্র কে সঙ্গে নিয়ে এই দ্বীপে আসেন এবং দ্বীপটি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে শরৎ চন্দ্র নাগা সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তার জমিদারীর সকল সম্পত্তি ১৮৭৬ সালে শ্রী শ্রী আদিনাথ মন্দির এর নামে দেবত্তর সম্পত্তি হিসাবে উইল করে দেন। আদিনাথ দ্বৈত ব্যবস্থাপনা পুরী এ্যাক্ট অণুযায়ী মোহন্ত শাসনে ছিল। পরবর্তীতে মোহন্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ১৯১১ সন হতে এর ব্যবস্থাপনা সীতাকুন্ড স্রাইন কমিটির অধীনে ন্যাস্ত রয়েছে।

 

কিভাবে যাবেনঃ

কক্সবাজার জেলার কস্তুরী ঘাট অথবা ৬ নং ঘাট এলাকা হতে ট্রলার ও স্পিড বোর্ট যোগে মহেশখালী যাওয়া যায়। ট্রলারে প্রায় ১ ঘন্টা ও স্পিড বোর্টে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রলার ও স্পিড বোর্ট পাওয়া যায়। এছাড়া কক্সবাজার জেলাধীন চকরিয়া উপজেলা সদর হতে ট্যাক্সি অথবা ব্যক্তিগত গাড়িযোগেও মহেশখালী যাওয়া যায়। মন্দিরে তীর্থ যাত্রীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মহেশখালীতে মোটামুটি মানের থাকার হোটেল আছে। তবে একটু উন্নত পরিবেশে থাকতে চাইলে কক্সবাজার অথবা চকরিয়া তে থাকা যেতে পারে।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: সাফায়েত,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 12, 2018

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.