আতিয়া মসজিদ (Atia Mosque/Masjid) বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদ যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই মসজিদটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে এবং এখানে নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ স্থাপনার তত্ত্বাবধান করছে।আরো পরিচিত করে বরতে গেলে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত ১০ (দশ) টাকা মূল্যমানের নোটের একপার্শ্বে ছবিটি আতিয়া মসজিদের।
পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলে আদম শাহ্ বাবা কাশ্মিরী নামে বিখ্যাত এক সুফি ধর্মপ্রচারক এখানে আগমন করে বসবাস করতে থাকেন এবং ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এই সাধকের মাজার এই আতিয়াতেই অবস্থিত।
তিনি বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসায়েন শাহ কর্তৃক আতিয়ার জায়গিরদার নিযুক্ত (১৫৯৮ সালে) হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ঐ সময় কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে তাঁর ধর্মীয় কার্য পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য বিশাল একটি এলাকা বা মহাল ওয়াকফ্ হিসাবে পান। তাঁকে এ এলাকা দান করা হলে এ দান বা ‘আতা’ থেকে সম্ভবত এ পরগণার নাম ‘আতিয়া’ হয়েছে।
শাহ্ বাবা কাশ্মিরী বৃদ্ধ বয়সে তাঁর পরামর্শে প্রিয় ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা নিয়োগ করেন। এই সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। সাঈদ খান পন্নী ১৬০৮ সালে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি দেলদুয়ার উপজেলা তথা টাঙ্গাইল জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ।এ মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরাণী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবী সংস্কার করেন।
মসজিদটির কিবলাকোটা ও বারান্দাসহ সার্বিক পরিমাণ ১৭.৭০ মিঃ ১২ মিটার। মসজিদের দেয়াল ২.২২ মিটার প্রশস্ত। বারান্দা ৩.৮২ ৭.৫ মিটার। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্যরীতির সুষম সমন্বয় এ মসজিদে দেখা যায় চারকোণে ৪টি বিরাট অষ্টকোণাকৃতীর মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক উপরে উঠে ছোট গম্বুজে শেষ হয়েছে।
বাংলার স্থাপত্যসমূহ মূলত ইটের তৈরি, কারণ পাথর এখানে সহজলভ্য নয়। তাই বাংলার স্থাপত্য এবং তার অলংকরণ সবই বিকশিত হয়েছে ইটের মাধ্যমেই। আতিয়া মসজিদও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। তবে এ মসজিদে সুলতানি স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যে যেমন বক্রাকার কার্নিশে, দ্বিকেন্দ্রিক সুচালো খিলান, গম্বুজ নির্মাণে বাংলা পান্দানতিভ ব্যবহার এবং উল্লেখযোগ্যভাবে পোড়ামাটির টেরাকোটা নক্শালংকারে।
আতিয়া মসজিদের গম্বুজের নির্মাণশৈলীতে দেখা যায় কিবলা কক্ষের উপর বড় গম্বুজটি খিলানভিত্তিক নির্মাণ পদ্ধতিতে (স্কুইঞ্জ পদ্ধতি) এবং বারান্দার উপর ছোট তিনটি গম্বুজ ‘বাংলা পান্দান্তিভ’ পদ্ধতিতে নির্মিত। পরবর্তিতে সংস্কারের সময় গম্বুজগুলো পলেস্তরা দিয়ে সমান করে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু মসজিদ নির্মাণের সময় এমন ছিলো না। আদিতে গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউতোলা ছিল। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে সুড়ঙ্গপথ সম্বলিত ভূগর্ভস্থ কবর নিয়ে নানা মতান্তর রয়েছে।
বাংলার সুলতানি এবং মোগল উভয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে নির্মিত আতিয়া জামে মসজিদ যুগসন্ধি লগ্নের মসজিদ স্থাপত্য-নিদর্শনরূপে চিহ্নিত। বাংলাদেশে যে সকল মুসলিম স্থাপত্যিক ঐতিহ্য রয়েছে তার মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি।
টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত মূল শিলালিপিগুলোর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদে প্রাপ্ত একটি আরবি একটি ফারসি শিলালিপি রয়েছে। এসবের মাধ্যমে মসজিদের নির্মাতা সময়কাল ও পূর্বের কিছু অসংতির সমাধান পাওয়া যায়। বিদায়ী সুলতানি আর নবাগত মোগল উভয় রীতির সংমিশ্রণে অপূর্ব এক মুসলিম স্থাপত্য, যা দৃষ্টিনন্দন ও এ অঞ্চলে বিরল।
কিভাবে আতিয়া মসজিদ যাবেন
টাঙ্গাইল শহর থেকে সিএনজি যোগে আতিয়া মসজিদ যাওয়া যায়।