বান্দরবানে যে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান আছে বগালেক(Bagakain Lake/ Boga Lake) তার মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এখানে পাহাড়ের উপর জলরাশি সঞ্চার করে তৈরি করেছে এই হ্রদ। সমুদ্র সমতল হতে প্রায় ১৭০০ ফিট উপরে পাহাড় চূড়ায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই অত্যাশ্চর্য হ্রদটি।
বিষয়টি যতটা না অবিশ্বাস্য, যতটা না অলৈাকিক তার চাইতেও বেশী এর সৌন্দর্য। শান্তজলের হ্রদ আকাশের কাছ থেকে একমুঠো নীল নিয়ে নিজেও ধারন করে নিয়েছে সেই বর্ণীল রং। পাহাড়ের চূড়ায় নীল জলের আস্তর নীল আকাশের সাথে মিশে তৈরি করেছে এক প্রাকৃতিক কোলাজ। মুগ্ধ নয়তে দেখতে হয় আকাশ পাহাড় আর জলের মিতালী। প্রকৃতি এখানে ঢেলে দিয়েছে একরাশ সবুজের ছোঁয়া। যেন তুলির আঁচড়ে বগালেকের পুরো জায়গা সেজেছে ক্যানভাসের রঙে আর প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এঁকেছে জলছবি।
বগালেক দুই ভাবে সমাদৃত ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। বগালেক গন্তব্য হিসেবে যেমন জনপ্রিয় আবার বগালেক পর্বতারোহীদের কাছে অনেকটাই বেস ক্যাম্পের মতো যারা রুমা হয়ে ট্রেকিং রুটগুলোতে যান। এ এমনই এক ছবি যা দেখামাত্র ভ্রমনপিপাসুদের ক্লান্তি-তৃষ্ণা উবে যায় মুহুর্তের মাঝে। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসার ক্লান্তি হারিয়ে যায় হ্রদের অতলগহ্বরে।
সবকিছু মিলে এ যেন এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বগালেককে অনেকে ড্রাগনলেকও বলে থাকে। বান্দরবন জেলা হতে ৭০ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলার কেউক্রাডং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এটি। এই হ্রদটি তিনদিক থেকে পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত। বগালেকের গড় গভীরতা আনুমানিক ১৫০ ফুটের মত। এটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ একটি হ্রদ।
এর আশেপাশে পানির কোন উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বগালেক যে উচ্চতায় অবস্থিত তা থেকে ১৫৩ মিটার নিচে একটি ছোট ঝর্ণার উৎস আছে যা বগাছড়া (জ্বালা-মুখ) নামে পরিচিত। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এই লেকের পানি প্রতি বছর এপ্রিল থেকে মে মাসে ঘোলাটে হয়ে যায়। আর লেকের সাথে সাথে আশেপাশের নদীর পানিও ঘোলাটে রং ধারণ করে। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন এর তলদেশে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। এই প্রস্রবণ থেকে পানি বের হওয়ার সময় হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়। প্রচুর মাছ ও জলজ লতাপাতায় ভরপুর এই হ্রদ।
সকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাত, প্রতি বেলাতেই বগালেক নতুন রূপে ধরা দেয়। এর সৌন্দর্য কাগজে কলমে লিখে আসলে বোঝানো সম্ভব নয়। নিজ চোখে না দেখলে কল্পনাতীত। সকালের উজ্জ্বল আলো যেমন বগালেককে দেয় স্নিগ্ধ সতেজ রূপ, ঠিক তেমনি রাতের বেলায় দেখা যায় ভিন্ন এক মায়াবী হাতছানি।
রাতের বগালেক দিনের বগালেক হতে একেবারেই আলাদা। আর যদি রাতটি হয় চাঁদনী রাত তবে এটি হতে পারে আপনার জীবনের সেরা রাতের একটি। কি অসাধারণ সে রূপ। নিকষকালো অন্ধকার রাতে পাহাড়ের বুক চিড়ে হঠাৎ একফালি চাঁদ মৃদু আলোর ঝলক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বগালেকের শান্তজলে। মৃদুমন্দ বাতাসে ছোট ছোট ঢেউয়ে দুলতে থাকে হ্রদের পানিতে চাঁদের ঝরে পড়া আলোকরাশি। নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলতে হয় এমন রূপে। চারিদিক নিস্তব্ধ, নিথর, জনমানবশুন্য। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, সেই নির্জন বেলায় বগালেকের পাড়ে বসে জোছনাস্নানের অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। মুহুর্তের মাঝেই যেন প্রেম হয়ে যাবে সে প্রকৃতির সাথে। প্রহরের পর প্রহর চলে যাবে, কিন্তু আপনাকে বসে থাকতে হবে অবিচল।
বগালেকের জন্ম ইতিহাস নিয়ে স্থানীয় পাহাড়ি গ্রামগুলোয় একটি মজার লোককথা প্রচলিত আছে, সেটি অনেকটা এরকম – “অনেক অনেক দিন আগে একটি চোঙা আকৃতির পাহাড় ছিল। দুর্গম পাহাড় ঘন অরণ্যে ঢাকা। পাহাড়ের কোলে বাস করত নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষ। ম্রো, বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা প্রভৃতি। তো সেই পাহাড়ের নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে প্রায়ই গবাদিপশু আর ছোট শিশুরা ওই চোঙ্গা আকৃতির পাহাড়টিতে হারিয়ে যেতো! অতিষ্ঠ গ্রামগুলো থেকে সাহসী যুবকদের দল এর কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে দেখতে পায়, সেই পাহাড়ের চূড়ার গর্তে এক ভয়ঙ্কর দর্শন বগা বাস করে। বম ভাষায় বগা মানে ড্রাগন। তারা কয়েকজন মিলে ড্রাগনটিকে আক্রমণ করে হত্যা করে ফেলে। ড্রাগনটির মৃত্যুর সাথে সাথে ড্রাগনের গুহা থেকে ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে আগুন বেরিয়ে এসে পুড়ে দেয় আশপাশ। নিমিষেই সেই পাহাড়ের চূড়ায় মনোরম একটি পাহাড়ি লেকের জন্ম হয়”
তবে বগালেকের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে বাংলাদেশের ভূ-তত্ত্ববিদগণ মনে করেন বগালেক মূলত মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।
বগালেক কিভাবে যাবেন
বগালেক যেতে অবশ্যই প্রথমে যেতে হবে রুমাবাজার। বান্দরবান শহর থেকে বাসে, নৌকায় কিংবা চান্দের গাড়ীতে করে প্রথমেই যেতে হবে রুমা বাজার। রুমা বাজার থেকে নতুন করে জিপ/চান্দের গাড়ী রিজার্ভ করে যেতে হবে কমলাবাজার পর্যন্ত। তবে বর্ষাকালে প্রায়ই ভূমিধ্বসের কারনে ১১মাইল নামক জায়গা পর্যন্ত আগানো যায় বড়জোর। তবে শুকনো মৌসুমে চান্দের গাড়ী বগালেক অবধি পৌঁছায়। রুমাবাজার থেকে ১১ মাইল কিংবা কমলাবাজার পর্যন্ত রাস্তা আপনাকে নিঃসন্দেহে মুফতে রোলার কোস্টারে চড়ার স্বাদ দিবে নিশ্চিত। কমলাবাজারের পাশ থেকেই খাড়া পাহাড় উঠে গেছে আকাশপানে, এটির চূড়াতেই বগালেক।
বগালেকের গাইড
রুমা বাজার থেকে গাইড পাবেন। আর্মি ক্যাম্পে গাইডের নামসহ আপনাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে। রেজিস্টার্ড গাইড ছাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি মিলবে না সামনে আগানোর। গাইড-কে প্রতিদিনের জন্য দিতে হবে ৩০০-৫০০/- টাকা!
বগালেকে কোথায় থাকবেন –
বগা লেকে থাকার জন্যে কিছু কুটির রয়েছে, সিয়াম দিদি আর লারাম বম এর বোর্ডিং উপায়ে পরিচালিত কটেজ প্রসিদ্ধ কম খরচে থাকার জন্যে। কিছু কটেজ একেবারে লেকের উপর মাচা তৈরি করে তার উপর। খাবার পাবেন যেখানে থাকবেন সেখানেই, তবে যা খাবেন রান্না করার সময় দিয়ে আগেই অর্ডার করতে হবে। থাকার জন্যে আগেই বুকিং দিতে নিচের নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন। লারাম বম-০১৫৫২৩৭৬৫৫১ তবে নেটওয়ার্ক স্বল্পতার কারনে বেশীরভাগ সময়ই নাম্বাটিতে সংযোগ করানো যায় না। এখানে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের একটি অত্যাধুনিক রেস্ট হাউজ নির্মাণাধীন রয়েছে। কিছুদিনের মাঝেই হয়তো সেখানে রাত্রিযাপন করার সুযোগ ঘটবে পযর্টকদের।
বগালেকে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা
খাবার জন্যে লারাম বম, সিয়াম বম (স্থানীয় স্কুল টিচার সিয়াম দিদি)সহ কয়েকটি দোকান আছে। প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যে রাতে থাকার ও তিন বেলা খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বগালেক কখন যাবেন
শুধুই বগালেক দেখতে যাবার জন্য হলে শীতকালে যাওয়া সবচেয়ে ভালো, কষ্ট একেবারেই কম। আর আপনি যদি রোমাঞ্চপ্রিয় হয়ে থাকেন আর পাহাড়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য দেখতে চান তবে বর্ষায় কিংবা বর্ষার পরপরই আসুন। বগালেকে একটি আর্মি ক্যাম্প রয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে এখানে কোন শঙ্কা নেই। তবে এখানে পৌছানোর সাথে সাথেই আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হয়।
বগালেকে অবশ্য পালনীয়
ভাল গ্রিপের জুতা বা কেডস পড়তে হবে। ঝিরি পথ পাড়ি দিতে চাইলে প্লাষ্টিকের গ্রিপওয়ালা স্যান্ডেল পড়তে হবে। অবশ্যই ব্যাগপ্যাক নেবেন এবং যথাসম্ভব কম কাপড় নেবেন (ট্রলি কিংবা হাতে নেবার ব্যাগ নিয়ে হাটাচলা অসম্ভব পাহাড়ে) পাহাড়ে সবসময় আইন মেনে চলবেন, কখনও পাহাড়িদের সংস্কৃতির প্রতি অসম্মানজনক কোনো আচরণ বা মন্তব্য করবেন না বন্য জীবজন্তু বা পরিবেশের কোন ক্ষতি করবেন না পাহাড়িদের বিশেষ করে মেয়েদের বিনা অনুমতিতে ছবি নেবেন না কোনো অবস্থাতেই গাইড ছাড়া একা কোথাও যাবে না। ঝিরি পথে হেটে যাবার জন্য সঙ্গে উপযুক্ত পরিমান খাবার নিয়ে নিতে হবে। কেননা পথে কোন খাবার পাবেন না।
বগালেকের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
কেওক্রাডং
একসময় কেওক্রাডং ছিল দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা প্রায় ৩১৭২ ফুট। এটিও রুমা উপজেলায় অবস্থিত। কেওক্রাডং যেতে চাইলে বগালেকে যেতে হবে দার্জিলিং পাড়ায়, দুঘণ্টার মতো লেগে যাবে। দার্জিলিং পাড়া যেতে পথে পড়বে চিংড়ি ঝর্ণা। দার্জিলিং পাড়া থেকে কেওক্রাডং খুব কাছেই। মাত্র ৩০ মিনিট ট্রেকিং করলেই পৌছানো যায় কেওক্রাডং চূড়ায়।
পাসিং পাড়া
এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত মানব বসতি। এখানে সব সময় আপনি মেঘের দেখা পাবেন। ইচ্ছে করলেই মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারেন। বেশ কয়েকটি রাত কাটিয়ে দেয়ার জন্য অসাধারণ একটি জায়গা। বগালেক থেকে কেওক্রাডং পৌঁছে ১০-১৫ মিনিট সামনে এগোলেই পেয়ে যাবেন অপরূপ সুন্দর পাসিংপাড়া।
সাইকতপাড়া
সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটি বম অধিবাসী অধ্যুষিত পাড়া। পাড়াটি বেশ ছিমছাম ও গোছানো। এমনিতে পাহাড়ীদের মধ্যে বমরা বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। এত উচ্চতায়ও এখানে বেশ বড় একটি খেলার মাঠ আছে। সারাক্ষণই বেশ জোরে ঠান্ডা বাতাস বয় এখানে। এখান থেকে কেওক্রাডং পাহাড় চূড়া দেখা যায়। এখানে আসতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে বগালেক। সেখান হতে প্রায় দেড় ঘন্টা হেটে পৌছতে হবে হারামুন পাড়ায়, হারামুন পাড়া বগালেক থেকে দার্জিলিং পাড়ার আগেই। হারামুন পাড়া থেকে দেড় ঘন্টার ট্রেকিং করলেই পৌছে যাবেন সাইকত পাড়ায়। কেউক্রাডং থেকে ফিরতি পথেও সাইকত পাড়া হয়ে ফিরে আসতে পারেন।
রিঝুক ঝর্না
প্রাকৃতিক পাহাড়ী পানির অবিরাম এ ধারাটি জেলা সদর হতে ৬৬ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে রুমা উপজেলায় অবস্থিত। নদী পথে রুমা হতে থানচি যাওয়ার পথে সাঙ্গু নদীর পাড়ে ৩০০ ফুট উঁচু থেকে সারা বছরই এ ঝর্ণাতে রিমঝিম শব্দে পানি পড়ে। রুমা হতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সহজেই এ স্থানে যাওয়া যায়। মার্মা ভাষায় একে রী স্বং স্বং বলা হয়। রুমা বাজার নৌকা ভাড়া ৫০০ টাকা হবে।