গাজীপুর উপজেলার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত একটি ঐতিহাসিক জনগপদ যা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ খ্রীস্টান মিশনারীর মর্যাাদায় আসীন তার নাম সেইন্ট নিকোলাস চার্চ (St. Nicholas Church)।
সেখানকার দেয়ালে খোদিত সময়কাল বলছে এটি আনুমানিক ১৬৬৩ সালে নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান নির্মাণ তারিখ হিসেবে সেখানকার দেয়ালে লেখা ১৮৮৮ সালের কথা। নতুন করে নির্মাণের পর বর্তমান সুদৃশ্য গির্জাটি দেখে অনেকের ভিরমি খাওয়ার দশা হতে পারে। দর্শক বলে বসতে পারেন, এত সুন্দর আধুনিক ধাঁচের গির্জাটি কীভাবে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন গির্জা হতে পারে?
গির্জাটির স্থাপত্য পরিকল্পনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে রয়েছে বারান্দাযুক্ত প্রবেশপথ; ২. সমবেত উপাসনার নিমিত্তে কক্ষ এবং বেদি ও একান্ত প্রার্থনা কক্ষ। তবে সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চে চিরাচরিত নার্দেক্স এর পরিবর্তে এ বাংলা ঘরের অনুকরণে চারটি মজবুত খুঁটির ওপর সমতল ছাদযুক্ত একটি বারান্দা তৈরি করা হয়েছে। এটা ইউরোপীয় গির্জা স্থাপত্যের দেশী চরিত্র হিসেবেও ধরা যেতে পারে। আর এর পেছনে কারণটা বোধ হয় কারিগর স্বল্পতা কিংবা এ দেশীয় প্রভাব। এখানে খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠান তৈরির পেছনে ইউরোপীয় দর্শন কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু যারা এর নির্মাতা তারা এ দেশী।
স্থানীয় নির্মাতারা দেশীয় কাঁচামালে গির্জা তৈরি করতে গিয়ে হয়তো চেয়েছে স্থাপত্যটি গড়ে উঠুক এ দেশীয় স্টাইলেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চাহিদা সামনে রেখে কাজ করতে গিয়ে হয়তো দুই দেশীয় রীতি মিলেমিশে একাকার হয়েছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এর বারান্দা দিয়ে তিনটি দরজার সাহায্যে একটি হলঘরে প্রবেশ করা সম্ভব। অনেকটা রেললাইনের মতো বারোটি লোহার খাম্বা রয়েছে সেখানে। এগুলো স্তম্ভাকারে ফাঁকা স্থানের ওপর নির্মিত ছাদটিকে ধারণ করেছে। এর সঙ্গে অনেকটা তেজগাঁও গির্জার মিল রয়েছে, যা আইল ও নেভের ভেদকারী অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে এ গির্জায়।
গির্জার এন্ট্রি স্পেস তথা প্রবেশ পথ মূলত সামনের দিকের বারান্দা হিসেবে কাজ করে। এটার উপরের ছাদ নির্মিত হয়েছে ছয়টি অষ্টকোণাকৃতির সেমি-গথিক স্তম্ভে ভিত্তি করে। এ খানে তিনটি সেমি-সার্কুলার প্রবেশ পথও রয়েছে। খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠানে নার্থেক্স তৈরির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল না রেখে এক্ষেত্রে নার্থেক্স তৈরি হয়েছে অনেকটাই দেশীয় স্টাইলে, যেখানে চার্চ স্থাপত্যের সঙ্গে স্থানীয় কুঁড়েঘর ধারার নির্মাণশৈলীর একটা ফিউশন লক্ষ করা যায় সহজেই। অন্যদিকে বারান্দা দিয়ে নেভে প্রবেশ করা যায়। এক্ষেত্রে একটি বৃহদাকৃতির অবলং হল ঘর রয়েছে, যা বারোটা স্তম্ভের ওপর অবস্থিত। এখানে থাকা রেললাইনের মতো স্তম্ভগুলোই একে আইল ও নেভে বিভক্ত করেছে। এ হলঘরের কোনার দিকে একটা সিঁড়ি ছিল বলে মনে করা হয়। এটা সামান্য কিছু চিহ্ন রেখে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়। এখানে একান্ত প্রার্থনা কক্ষ অল্টারের সঙ্গে সংযুক্ত, যেখানে একটি লেন্স আকৃতির খিলানপথ দিয়ে প্রবেশ করা যায়। তবে এ খিলানপথ তুলনামূলকভাবে অনেক অপরিসর ও ঘিঞ্জি আকৃতির বলেই মনে হয়। আয়তাকার এ চার্চ স্থাপত্যটি অনেকটাই উত্তর-দক্ষিণ ডিরেকশনে তৈরি, যেখানে উত্তরেই এর প্রবেশমুখ লক্ষ করা যায়।
দেশী-বিদেশী রীতির মিশ্রণে তৈরি এ গির্জায় রয়েছে মোট চারটি প্রবেশপথ। এর প্রথম তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে বারান্দা দিয়ে ঢোকার অবলম্বন হিসেবে উত্তর দিকে। তবে দক্ষিণ দিকে একান্ত প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্যও রয়েছে আরেকটি প্রবেশপথ, যেটি আবার খিলান দিয়ে অলঙ্কৃত। এ প্রবেশপথগুলো বাদ দিলেও এর পূর্ব ও পশ্চিমে মোট ছয়টি করে বারোটি উন্মুক্ত জানালা রয়েছে। এর থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে, সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চ তৈরির সময় ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলার উষ্ণ আর্দ্র প্রকৃতির কথা মাথায় রেখেই স্থাপত্য পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। এখানে এতগুলো জানালা রাখার একটাই কারণ। তা হচ্ছে— বাইরে থেকে বায়ু চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত করা।
গির্জাটির ফ্যাসেড ট্রিটমেন্ট ও অলঙ্করণের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায় বিশেষ বৈচিত্র্য। এর পোর্চ বে নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে চারটি অষ্টকোণী স্তম্ভ। আর হলঘরে প্রবেশের তিনটি সেমি সার্কুলার খিলানপথের কথা আগেই বলা হয়েছে। এগুলোর চারপাশে বেশ সুন্দর অলঙ্করণ লক্ষ করা গেছে। এর ওপর রয়েছে একটি সুদৃশ্য ক্রুশ ও ঘণ্টা যা বিশেষ ধরনের গথিক খিলানের মধ্যে প্রোথিত। খিলানাকৃতির প্রবেশ পথের স্প্যানড্রেল, দরজার উপরিভাগ ও জানালার উপরের অংশ জালি অলঙ্করণে সুশোভিত। পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিটি জানালাতেই সুদৃশ্য অলঙ্করণ লক্ষ করা যায়। পুরো স্থাপত্যটির ওপর যে প্যারাপেট, সেখানে রয়েছে কণিক আকৃতির কিয়স্ক বা ছত্রী। অন্যদিকে গির্জার উত্তর-পশ্চিম কোণে গ্রট্টো অবস্থিত।
এখান থেকে কালীগঞ্জের আঞ্চলিক বাংলা ভাষার প্রথম বাইবেল অনুদিত হয়। সর্বপ্রথম বাংলা ভাষার দ্বিভাষিক অভিধান ও প্রথম গদ্য ছাপার বইও প্রকাশিত হয়।
কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে টঙ্গি, টঙ্গি থেকে কালীগঞ্জের বাসে বা সিএনজিতে চড়ে টঙ্গীর আহসানুল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু পেরিয়ে নামতে হবে নলছটা সেতু। সেখান থেকে সেইন্ট নিকোলাস চার্চ এর দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার।