ভিতরগড় – পঞ্চগড়

এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গনগরী। ভিতরগড়ের(Bhitargarh) বাইরের আবেষ্টনীর উত্তর দেয়াল এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালের উত্তরাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অর্ন্তগত।পুরাতন হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশীয় সমতল ভূমিতে তরাই অঞ্চলে অবস্থিত ভিতরগড়ের উপরিভাগে রয়েছে গাঢ় ধূসর বা কালো রঙের বেলে দোয়াশ মাটি- যা তরাই কালো মাটি হিসেবে পরিচিত। ভারতের জলপাইগুড়ি হতে উৎপন্ন তালমা ও কুড়ুম নদী দুটিই ছিল ভিতরগড়ে পানি সরবরাহের প্রধান উৎস।

ভিতরগড় দুর্গনগরী মূলত চারটি আবেষ্টনীর সমন্বয়ে গঠিত। এই আবেষ্টনীসমূহ একটি অপরটির ভিতরে অবস্থিত। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনী বা প্রথম আবেষ্টনীর উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালসমূহের পরিমাপ যথাক্রমে ৩৪০ মিটার, ৬৫০ মিটার, ৬১০ মিটার ও ৪৫০ মিটার। এই দেয়ালসমূহ সম্পূর্ণরূপে ইট দ্বারা নির্মিত। দেয়ালসমূহ বর্তমানে ২.৫৫ মিটার উঁচু এবং উপরিভাগে ২ মিটার প্রশস্ত। দেয়ালসমূহ সুদৃঢ় করার নিমিত্তে বাইরের দিকে দেয়ালের সাথে আয়তাকৃতির বুরুজ সম্পৃক্ত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীতে ব্যবহূত ইটের পরিমাপ ২৪ × ২৩ × ৫ সেমি, ২৩ × ২২ × ৫ সেমি, ২২ × ২০ × ৫ সেমি এবং ২০ ১৮ ৪ সেমি। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর উত্তর পূর্বাংশে সম্ভবত রাজবাড়ি ছিল। এই আবেষ্টনীর ভিতরে দুটি প্রাচীন দিঘি রয়েছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে লেখক কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এই অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে একটি ক্রুশাকৃতির মন্দির এবং উভয় দিকে (পূর্ব ও পশ্চিম) স্তম্ভ বিশিষ্ট বারান্দা সম্বলিত পিরামিডাকৃতির একটি স্তূপ/মন্দির আবিস্কৃত হয়েছে।

২৭ মি × ২২ মি জায়গার উপর ইট নির্মিত ক্রুশাকৃতির মন্দিরটির কেন্দ্রে রয়েছে ৯ মি × ৯ মি একটি কেন্দ্রীয় কক্ষ। এই কক্ষের চারদিকে রয়েছে চারটি কক্ষ। উত্তর দিকের কক্ষটির পরিমাপ ৬.৪০ মি × ৫.৮০ মি এবং পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের কক্ষ তিনটির পরিমাপ হলো- ৪.২৮ মি × ৩.৬০ মি। মন্দিরে ব্যবহূত ইটের পরিমাপ হলো ২২ × ২০ × ৫ সেমি এবং ২০ × ১৮ × ৪ সেমি। উৎখননকালে মন্দির স্থাপত্যে ব্যবহূত বিভিন্ন নকশা খচিত ইট ও ত্রিকোনাকৃতির পাথরের খন্ড পাওয়া গেছে।

উপরোক্ত মন্দির হতে ১২০ মিটার দক্ষিণ পশ্চিমে একটি ইট নির্মিত স্থাপত্যের ভিত্তি লেখক কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননকালে পাওয়া গেছে। এটি সম্ভবত স্তূপ বা মন্দির হিসেবে ব্যবহূত হতো। এই স্থাপত্যটির কেন্দ্রে রয়েছে ২.১৪ মিটার পুরু দেয়াল দ্বারা সৃষ্ট একটি বর্গক্ষেত্র যার প্রতিটি বাহুর পরিমাপ ৬.২৫ মিটার। এই কেন্দ্রীয় বর্গক্ষেত্রটি চর্তুদিকে ৩.০৫ মিটার দূরত্বে ১৯.৮০ মিটার দীর্ঘ ও ১.৫৩ মিটার পুরু দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ অংশটি হতে আবার ২.৭৫ মিটার দূরত্বে ১.২৫ মিটার পুরু ও ২৭.৫০ মিটার দীর্ঘ দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই তিনটি বর্গের দেয়ালের পুরুত্ব হতে সহজেই অনুমেয় যে, স্থাপত্যটি মূলত পিরামিডাকৃতির ছিল। এর বাইরের বর্গক্ষেত্রটির পূর্ব ও পশ্চিম বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে ১৬টি স্তম্ভ সম্বলিত একটি করে আয়তাকৃতির বারান্দা (অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ১০.৫ মি × ৯.৫ মি) সম্পৃক্ত ছিল। পূর্ব দিকের স্তম্ভ বিশিষ্ট বারান্দার পূর্বে ৪.৭৫ মি × ২.৫৫ মি সংলগ্ন অংশটি সম্ভবত প্রবেশ পথের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এখানে ব্যবহূত ইটের পরিমাপ হল ২৪ × ২৩ × ৫ সেমি, ২৩ × ২২ × ৫ সেমি, ২২ × ২০ × ৫ সেমি এবং ২০ × ১৮ × ৪ সেমি। উৎখননকালে এই স্থাপত্যের ভিত্তির নিচের স্তরে লাল ও ধূসর রঙের নকশা খচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ এবং লোহা ও তামার তৈরী দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে বেশিরভাগই হল- থালা, বাটি, রান্নার হাড়ি, তাওয়া ও মাটির প্রদ্বীপ। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে একটি কালো পাথরে তৈরি মনসা মূর্তির ভগ্নাংশ (১০.৬ × ৮.২ সেমি) পাওয়া গেছে যা বর্তমানে পঞ্চগড় মহিলা কলেজের রকস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

প্রথম আবেষ্টনী এবং মহারাজার দিঘিসহ পাচঁটি প্রাচীন দিঘিকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে দ্বিতীয় আবেষ্টনী। ইট নির্মিত এই দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালসমূহের পরিমাপ যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণে ১.৪ কিমি, পূর্বে ২.৮৬ কিমি এবং পশ্চিমে ৩ কিমি। ইট নির্মিত দেয়ালসমূহ বর্তমানে ৩.৫ মিটার উঁচু এবং উপরিভাগে ২.৫ মিটার প্রশস্ত। ব্যবহূত ইটের পরিমাপ ২২ × ২০ × ৫ সেমি এবং ২০ × ১৮ × ৪ সেমি। পশ্চিম দেয়ালটি শালমারা নদীর প্রবাহ অনুসরণ করে নদীর পূর্ব তীরে নির্মিত বলে প্রচুর আঁকাবাঁকা। প্রথম আবেষ্টনীর ন্যায় দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালসমূহের বাইরেও আয়তাকৃতির বুরুজ সংযোজিত রয়েছে। দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালসমূহের বাইরে চতুর্দিকে ১৯ মিটার প্রশস্ত এবং ৪.৫ মিটার গভীর পরিখা রয়েছে- যার অনেকাংশেই বর্ষাকালে পানি থাকে। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, এই দ্বিতীয় আবেষ্টনীর উত্তরে কালদুয়ার এবং দক্ষিণে যমদুয়ার নামে দুটি প্রবেশদ্বার ছিল।

দ্বিতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে পাঁচটি প্রাচীন দিঘির নাম হলো- মহারাজার দিঘি, ফুলপুকুরী, কোদালধোয়া, মলানী দিঘি এবং সিঙ্গারী দিঘি। তন্মধ্যে মহারাজার দিঘি সর্ববৃহৎ- যা ৫৩ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। দ্বিতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত মহারাজার দিঘির চতুর্দিক ইট ও মাটি নির্মিত ৬ মিটার উঁচু পাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। পাড়সহ দীঘির পরিমাপ উত্তরে ৩৭৬.৪৩ মিটার, দক্ষিণে ৩৬৭.২৪ মিটার এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ৬৯১.৩১ মিটার। দিঘির গভীরতা প্রায় ৯ মিটার। দিঘিতে পূর্ব ও পশ্চিমে তিনটি করে এবং উত্তর ও দক্ষিণে ২টি করে মোট দশটি ইট বাঁধানো ঘাট রয়েছে। মহারাজার দিঘির পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং দিঘির ভিতরে কোনো জলজ উদ্ভিদ নেই।

অবস্থানঃ

ভিতরগড় পঞ্চগড় জেলা শহর হতে ১৬ কিমি উত্তর পূর্বে পঞ্চগড় জেলার সদর থানার অর্ন্তগত অমরখানা ইউনিয়নে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় ২৫ বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে অবস্থিত।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: সাফায়েত,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 22, 2018

ভিতরগড় – পঞ্চগড়, সম্পর্কে পর্যটকদের রিভিউ।

  1. ভিতরগড় দুর্গের আরও কিছু ছবি যোগ করতে পারেন। তাহলে ধারনা পাওয়া যাবে। এমনিতে আমার প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট ঘুরতে আপত্তি নেই। কিন্তু ভিতরগড় দুর্গে গিয়ে একটু হতাশই হয়েছিলাম। প্রত্যাশা আরেকটু বেশি ছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.