চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের হাইল-হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরূপ। পর্যটন শিল্পের জন্য এক অপার সম্ভাবনাময় হাইল-হাওরটি শুষ্ক মওসুমে সবুজের সমারোহ আর বর্ষায় জলকেলির খেলা। শীত মওসুমে বিচিত্র পাখির ঝাঁকে ঝাঁকে আগমন পর্যটক, দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ শ্রী আর মঙ্গলের অর্থাৎ সুন্দর ও শান্তির শহর শ্রীমঙ্গল। চায়ের স্বর্গরাজ্য শ্রীমঙ্গলের পাশেই মাছ আর পাখির অভয়াশ্রম হাইল-হাওরের বাইক্কার বিল(Baiqca bil)। রাজধানী ঢাকা থেকে হাইল-হাওরের বাইক্কা বিলের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার আর শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার। হাইল-হাওরের পূর্ব পাশেই প্রায় ১০০ হেক্টর জলাভূমি নিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের এই বাইক্কা বিল।
জেলা শহরের রাস্তাটি যেদিকে চলে গেছে, ঠিক সেদিক দিয়েই পৌঁছতে হয় বাইক্কার বিলে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রসিদ্ধ হাইল হাওরে অবস্থিত সরকারি সংরক্ষিত বাইক্কা বিলটি এখন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে। বলা যায়, অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত এ বিলটি এখন বিনোদনের আকর্ষণীয় স্থান। নয়নাভিরাম দৃশ্য আর হাজার হাজার পাখির কলতানে মুখরিত বাইক্কা বিল দেখতে শীতের শুরু থেকেই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের আগমন শুরু হয় এ বিলে। বাইক্কা বিল শ্রীমঙ্গল তথা বাংলাদেশের একটি অনন্য স্থায়ী মত্স্য অভয়াশ্রম। এককালের মত্স্যসম্পদে সমৃদ্ধ হাইল-হাওরে এর অবস্থান। বাইক্কা বিলের আয়তন ১০০ হেক্টর। মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এ বাইক্কা বিলটি। আইড়, কৈ, মেনি, ফলি ও পাবদাসহ আরও অনেক প্রজাতির মাছ এখানে বংশ বৃদ্ধি করে পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে একটি স্থায়ী মত্স্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এ বিল শুধু মাছের জন্যই নয়, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য একটি চমত্কার নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয়।
সংরক্ষিত মত্স্য অভয়াশ্রমে গত ৫-৬ বছর ধরে শীত মৌসুমে অতিথি পাখিদের অন্যতম অভয়াশ্রম এই বাইক্কা বিলে হাজার মাইল দূর থেকে প্রতি শীত মওসুমে এসে ভিড় করে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। সকাল-সন্ধ্যা এই অতিথি ও স্থানীয় পাখির ওড়াউড়ি আর কলকাকলিতে মুখর বিলটি হয়ে ওঠে পাখির রাজ্যে। এ বিলে মত্স্যসম্পদ যেমন বাড়ছে, তেমনি হাজার হাজার অতিথি পাখির আগমনে এলাকাটি মুখর হয়ে ওঠে। সে সঙ্গে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে। দেশ-বিদেশ ও দূরদূরান্তের মানুষ এ দর্শনীয় স্থানটি দেখতে ছুটে আসেন। বাইক্কা বিলের আকর্ষণে ছুটে আসা দর্শনার্থী, পর্যটক, প্রকৃতিপ্রেমী ও পাখি দর্শকদের জন্য সম্প্রতি এখানে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এ পর্যবেক্ষণ টাওয়াটি দ্বিতলবিশিষ্ট। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মুহূর্তেই পৌঁছা যায় উচ্চচূড়ায়। ওখানে সংরক্ষিত রয়েছে পাখি ও মাছের বিভিন্ন তথ্য। অতিথি পাখি কোন পথ ধরে আমাদের দেশে ছুটে আসে, তারও বর্ণনা আছে। টাওয়ারে বসে বসে দূরের পাখি কিংবা জলজসম্পদকে স্পষ্টভাবে দেখার জন্য রয়েছে বাইনোকুলার ও টেলিস্কোপ। ইন্টিগ্রেটেড প্রটেক্টেড এরিয়া কো-ম্যানেজমেন্ট আইপ্যাক সূত্র জানায়, প্রতি বছর শীত মৌসুমে পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, ধুপনিবক, রাঙাবক, দলপিপি, নেউপিপি, পানমুরগি, বেগুনি কালেম, কালোমাথা, কাস্তেচড়া, গেওয়ালা বাটান, মেটে মাথা টিটি প্রভৃতি পাখি এ বিলে আসে। এ বিলের প্রধান আকর্ষণ বুনো হাঁস। তবে বালি হাঁস এ বিলের স্থায়ী বাসিন্দা।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ক্রেল সূত্র জানায়, হাইল-হাওরটি বর্ষায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয় এবং শুষ্ক মওসুমে ১৩০টি বিল ও বেশ কয়েকটি খালে খণ্ডিত হয়ে চার হাজার হেক্টর জলাভূমিতে সঙ্কুচিত হয়ে যায়। হাইল-হাওর এলাকার ৬০টি গ্রামের ৩০ হাজার বসতবাড়িতে প্রায় এক লাখ ৭২ হাজার মানুষ বাস করেন। পশুচারণা, পশু খাদ্য আহরণ, গৃহনির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ, খাদ্য ও ঔষধি হিসেবে শাকপাতার প্রয়োজনে হাওরের ওপরই নির্ভরশীল এসব মানুষ।
সংরক্ষিত মৎস্য অভয়াশ্রম বাইক্কা বিলটি ইউএস আইডির অর্থায়নে গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য ও পাখির এ অভয়াশ্রম। অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত এ বিল এখন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। নয়নাভিরাম জলাভূমিতে হাজারো শাপলা আর পদ্মফুল ফোটে। বিলের পানির ওপর ঘুরে বেড়ায় ফড়িং। সকাল-বিকেল চলে রঙিন ফড়িংয়ের বিরতিহীন শোভাযাত্রা। বিলে ফুলের পাশে আসে রঙিন প্রজাপতির দল। জীববৈচিত্র্য ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাইক্কা বিল জলজ সম্পদের অমূল্য ভাণ্ডার।
মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, শ্রীমঙ্গলের হাইল-হাওর মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে ৭০ প্রজাতির মাছ। এ ছাড়াও আরো ১৮ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ রয়েছে। বিরল নীলপদ্মসহ মাখনা, পানিসিঙ্গারা, পদ্মটোনা, শাপলা, শালুক, শামুক, ঝিনুকসহ জলজ সম্পদের ভরপুর এ হাওর। শীতকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে হাজার হাজার অতিথি পাখি। হাওরটি ৯৮ প্রজাতির মাছের আবাসভূমি ও ১৬০ প্রজাতির পাখির বিচরণক্ষেত্র। প্রতি বছর এখানে বিপুল পাখির আগমন ঘটায় এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাসের আওতায় হাইল-হাওরে পাখিশুমারি অনুষ্ঠিত হয় এবং এ তথ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে এ হাইল-হাওরটি এখন গুরুত্বপূর্ণ পাখি এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
শিক্ষা-গবেষণা ও চিত্র-বিনোদনের জন্য এই হাইল-হাওরের বাইক্কা বিল এখন অনন্য বিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিলের পানিতে ফোটা হাজারো পানা, শাপলা, পদ্ম আর নীলপদ্ম শোভিত মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা দেখে পর্যটক ও প্রকৃতিপিপাসুরা বিমোহিত হন। ২০০৩ সালের ১ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এই বিল শুধু মাছের জন্যই নয়, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য একটি চমৎকার নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে পর্যটক সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাহাড়-অরণ্য, চা বাগান ও প্রাচীন নিদর্শনের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের আরেক সম্ভাবনাময় স্থান এই হাইল-হাওর। এই হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরূপ। বিশেষ করে হাইল হাওরের বাইক্কা বিলের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে যেতে হয় শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গল নেমে সিএনজি চালিত অটো রিকসা কিংবা মাইক্রোতে চেপে বাইক্কা বিল। শুধু বাইক্কা বিল দেখলে দিনে গিয়ে তুমি দিনেই ফিরে আসতে পারবে। তবে হাতে সময় নিয়ে যাওয়াই ভাল। তাহলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ পুরো শ্রীমঙ্গল ঘুরে আসা যাবে। এখানে চা বাগান অসাধারণ। কাছেই ফিনলের চা বাগানে ঘুরে আসতে পারবে। আবার এক ঘন্টার দূরত্বে সমশের নগর গিয়ে ডানকান চা বাগানেও ঘুরে আসা যায়। ডানকানদের গলফ ফিল্ড অসাধারণ। যাই করনা কেন, শ্রীমঙ্গলে থাকা-খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। আবার শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কমলগঞ্জ সড়কে লাউড়াছড়া বনের কাছে রয়েছে বিলাসবহুল টি-রিসোর্ট।