মসজিদের শহর ঢাকার একটি ঐতিহাসিক মসজিদ হচ্ছে তারা মসজিদ(Tara Masjid)। এটি আঠারো শতকের প্রথম দিকে নির্মিত একটি প্রাচীন মসজিদ। তারা মসজিদটি পুরানো ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত রোড়ে অবস্থিত।
জানা যায়, ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। তখন এ মসিজিদটি মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে বেশ পরিচিতি পায়। নির্মাণকালে মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজ রীতির। ১৮৬০ সালে মির্জা গোলাম পীর মারা যাওয়ার পর, ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় তিনি মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা সংযোজন করেন এবং সমগ্র ইমারতটি মূল্যবান জাপানি ও ইংলিশ রঙিন টাইলস দিয়ে তারার মোটিফে সজ্জিত করেন।
সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটিকে বর্তমানে পাঁচ গম্বুজ মসজিদে রূপান্তর করা হলেও প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি তিন গম্বুজ রীতিরই। আর মসজিদের গম্বুজ থেকে দেয়াল পর্যন্ত অলঙ্করণের বিষয়বস্তুতে তারা নকশার আধিক্যের কারণে মসজিদটি পরবর্তীকালে তারা মসজিদ নামেই পরিচিতি পায়।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটির ফের সংস্কার করা হয়। এই সময় পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে এর গম্বুজ সংখ্যা পাঁচটিতে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে মসজিদের জায়গা সম্প্রসারিত হয়।
মসজিদের জুল্লায় প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পথ সৃষ্ট করা হয়েছে। এ খিলানগুলি বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং চারটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ হতে উত্থিত। মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সম্পূর্ণরূপে মোজাইক নকশা করা। এ গাত্রালংকারে চিনামাটির প্লেট, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহূত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি টিকরী’ বা চিনি দানার কাজ বলা হয়।
ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি মসজিদের গাত্রনকশায় বিধৃত হয়েছে। এ মসজিদের অলংকরণ জুল্লার অভ্যন্তরে ফুলদানি থেকে উত্থিত ফুলগাছ, খিলান শীর্ষে পেন্ডেন্টিভের উপর ও দেয়ালগাত্রে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। বারান্দায় গাত্রালংকারে জাপানের বিখ্যাত ‘ফুজিসান’-এর দৃশ্যসম্বলিত গ্লেস টাইল উল্লেখযোগ্য। ‘ফাসাদ’ এর কেন্দ্রে আরবি লিপি সম্বলিত সূক্ষ্ম অর্ধচন্দ্র ও তারার অলংকরণ স্থান পেয়েছে। বৃত্তাকার শ্বেত-শুভ্র গম্বুজগুলিতে বসানো হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারা বা নক্ষত্র। সমগ্র নকশায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে তারার ‘মোটিফ’; তাই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে খ্যাত।
যদিও পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি গলি আর কোলাহলের ভিড়ে দর্শনার্থীদের তারা মসজিদ খুঁজে পেতে একটু মুশকিলই হয়। তবে এর সামনে দাঁড়ালে মনের বিরক্তিগুলো কর্পূরের মতো উড়ে যাবে। দর্শনার্থীর মনে ভর করে প্রশান্তির শ্যামল ছায়া। এর কারুকাজমণ্ডিত দেয়াল আর গম্বুজগুলো চোখের সামনে মুঘলদের সৌন্দর্যপিপাসু মনের কথাই ঘোষণা করে। মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে সামনের খোলা মাঠে প্রথমেই তারা আকৃতির একটি ফোয়ারা রয়েছে।
এর চারদিকে সবুজ ঘাসের ওপর মোজাইক টাইল দিয়ে নামাজিদের মসজিদে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। এগুলো এর সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়েছে। এর পাঁচটি গম্বুজের গায়ে ও ভেতরের ডিজাইনগুলো দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। লতাপাতা আর বিভিন্ন ফুলের সমাহারে মন হারিয়ে যাবে মুঘল আমলে। মুগ্ধ নয়নে কারুকাজগুলো দেখতে দেখতে আপনার মনে হতে পারে, আপনি কোনো মুঘল বাদশাহর দরবারে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রতিদিন ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকার শতশত দর্শনার্থী এটির সৌন্দর্য অবলোকন করে মুগ্ধ হন। প্রতি ওয়াক্তেই এখানে প্রায় শতাধিক নামাজি নামাজে অংশগ্রহণ করেন।
যেভাবে যাবেনঃ
পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল থেকে রিকশায় করে সহজেই মসজিদটিতে যাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রিকশা ভাড়া লাগবে ৩০ টাকা।