কালের বিবর্তনে বাংলার মাটি থেকে অনেক আগেই জমিদার ও জমিদারী প্রথা উঠে গেছে, কিন্তু মুছে যায়নি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। জমিদারদের নির্মিত বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা গুলো আজো কালের সাক্ষি হয়ে দাড়িয়ে আছে। তেমনি একটি জমিদার বাড়ি হচ্ছে কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুর জমিদার বাড়ি (Muradnagur Jahapur Zamidar Bari)।
গোমতি বিধৌত জাহাপুরে এ জমিদার বাড়িটি অবস্থিত বলে এর নাম জাহাপুর জমিদার বাড়ি (Jahapur Zamindar Bari)। জমিদার বাড়িটির বয়স ৪০০ বছর হলেও তাদের জমিদারীর বয়স এত দিনের নয়। মূলত ১২৮০ বঙ্গাব্দের ৭ মাঘ (১৮৬২ খিস্টাব্দ) জমিদারীর গোড়াপত্তন হয়। ঢাকা জেলার সরোজী মহালের জমিদার রাধিকা মোহন দাস হতে শ্রী গৌরি মোহন রায় এ বংশের জমিদারী শুরু হয়। একই সময়ে জমিদারী লাভ করেন তার ভাই রাম দয়াল ও কমলাকান্ত রায়। তারা দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলেন। প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করে তারা ঢাকার নবাবদের নিকট জমা দিতেন।
জমিদার বাড়িতে ঢুকতে বাড়ির প্রথম ফটকে দুইটি সিংহের মূর্তি রয়েছে। এই জমিদার বাড়িতে মোট ১০টি প্রাসাদ বা ভবন আছে। প্রথম ভবনটি তিনতলা আর সবগুলোই দুইতলা বিশিষ্ট। এর মধ্যে দুইটি ভবন প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কয়েকটি লতাপাতায় জরাজীর্ণ হয়ে রয়েছে। বাকীগুলো মোটামুটি এখনো ভালো আছে।
জমিদার বাড়ির সর্বশেষ ভবনটি তৈরি করেন বর্তমান বংশধর প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায়ের দাদা জমিদার অশ্বীনি কুমার রায়। এছাড়াও তিনি এখানে জগন্নাথ দেবের রথ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সবগুলো ভবনেই বিভিন্ন ধরণের ফুলের নকশা রয়েছে। এমনকি জানালার গ্রীলগুলোতেও নকশা রয়েছে। জানা যায় বাড়িগুলোর নকশা তৈরি করতে ঢাকার বিক্রমপুরের মিস্ত্রিদের আনা হয়েছিল। ভবনগুলোর নকশাগুলো মুঘল রীতিতে তৈরি করা হয়েছে। ভবনগুলো ইংরেজি বর্ণ I এবং L টাইপে করা হয়েছে।
প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একটি মন্দির দেখতে পাবেন। এটি নাট মন্দির। দুর্গা পূজার সময় এখানে ভক্তরা সমবেত হন। পাশেই রয়েছে দুর্গাদেবীর প্রতিমা। প্রতিমাটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
এখান থেকে সোজা চলে যাবেন অন্দর মহলে। এ মহলেই বর্তমান বংশধররা বসবাস করছে। এখানে দেখা হবে ১১তম বংশধর শ্রী আশীষ কুমার রায়, সমরেন্দ্র রায় ও অজিত কুমার রায়ের সঙ্গে। এছাড়া রয়েছেন প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায়, অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায় ও তাদের পরিবারবর্গ। তারাই বর্তমানে এ বিশাল বাড়িটি দেখাশোনা করছেন। জমিদারদের আরও ২টি পরিবার এখানে বসবাস করছে। তাদের কারও সঙ্গে আপনার দেখা নাও হতে পারে।
আপনার চোখের সামনের ভবনটির দরজার ওপরে খোদাই করা লেখা ‘১৩৩৪ বঙ্গাব্দ’ দেখবেন। এটি তৈরি করেছন অঞ্জন কুমার রায়ের দাদা অশ্বিনী কুমার রায়। এটি জমিদার বাড়ির সর্বশেষ ভবন। এর সামনে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। ফ্লোর থেকে ছাদের উচ্চতা ১৪ ফুট। ছাদের নিচের অংশে কাঠের এবং লোহার তৈরি কারুকার্যময় সিলিং দেখতে পাবেন। দোতলায় ওঠার জন্য সরু সিঁড়ি দেখতে পাবেন।একটু ওঠে মাঝখানে দাঁড়াবেন। দোতলায় ৮ থেকে ১০টি কক্ষ। ইচ্ছে করলে ছাদ থেকে প্রায় ৩ একর আয়তনবিশিষ্ট পুরো জমিদার বাড়িটি দেখতে পারেন।
বাড়ির বাইরের অংশে সুউচ্চ দেয়াল দেখবেন। একদিকে কাঁটা তারের বেড়া রয়েছে। একে একে সবগুলো ভবন ঘুরে দেখুন।
এবার প্রবেশ করুন রানী মহলে। সেখানে গিয়ে রানী নন্দ রানী, মহামায়া রায়, ও শ্যামা সুন্দরী দেবীর স্মৃতি মনে পড়বে। রানী মহলের সামনে একটি পুকুর ছিল। ওই পুকুরের পানিতে জাফরান মিশিয়ে রানীরা গোসল করতেন। এছাড়া হস্তচালিত পাম্পের মাধ্যমে ৩ তলায় পানি উঠিয়ে রানীরা গৃহকর্ম সম্পাদন করতেন।
এবার চলে আসুন বেডরুমে। জমিদারদের ব্যবহৃত শৌখিন খাট, নকশা করা চেয়ার, গা এলিয়ে দেয়া ইজি চেয়ার, কারুকার্যখচিত ফুলদানি সবকিছুই দেখতে পাবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানবেন, সেগুন কাঠের তৈরি নকশা করা আসবাবপত্রগুলো শতাধিক বছরের পুরনো।
এবার আয়নামহলের দিকে এগিয়ে যান। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাচ-গানের আসর বসত। ওই সময় ব্যবহৃত দু-একটি হ্যাজাক লাইট দেখতে পাবেন।শৌখিন জমিদাররা জারবাতি ব্যবহার করতেন। তবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলোতে মোমবাতি ব্যবহার করা হতো। তখন কোন বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় হাতেটানা পাখা ব্যবহার করা হতো। এমন পাখা রঞ্জন বাবুর কাছে সন্ধান করলে দেখতে পাবেন।
বসতঘরের সামনে একটি ছোট্ট বাগান দেখতে পাবেন। এ বাগানে এক সময় শোভা পেত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা রঙ-বেরঙের ফুল গাছ। উড়িষ্যা থেকে আনা গোলাচি গাছটি দীর্ঘ দিন জীবিত ছিল। এখনও আছে নয়নাভিরাম পারিজাত, চাপা, ম্যাগনেশিয়াম ও কনকচাঁপা।এছাড়া পৃথক ফলবাগানও ছিল।
এবার আপনি চলুন ডাইনিং রুমে। এখানে নিয়মিত কয়েকজন পাকা রাঁধুনি থাকত। জমিদার পরিবারের সদস্য ছাড়াও খাওয়া-দাওয়া করত পাইক-পেয়াদা ও খাজনা আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারীরা। জমিদারদের ব্যবহৃত শ্বেত পাথরের একটি প্লেট দেখে নিজের চোখকে ধন্য করতে পারেন।
ডাইনিং রুমের চারদিকে চোখ রাখুন, দুর্লভ অনেক কিছু চোখে পড়বে। বর্তমানে আমরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ব্যবহার করি। আজ থেকে ১শ’ বছর আগেও জমিদাররা যে কতটা স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন তা দরজার পাশে রাখা ফিল্টারটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। ফিল্টারটির নিচের অংশে চোখ নিলে দেখতে পাবেন ছোট্ট করে লেখা রয়েছে, ‘মেইড ইন লন্ডন’।
এবার খাওয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসুন। বের হওয়ার রাস্তায় দেখবেন একটি ছাতা। তবে এটি যেনতেন ছাতা নয়, রুপার হাতলের ছাতা।জমিদার বাবুরা যখন প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখার জন্য বের হতেন তখন দু’জন লোক এটি বয়ে বেড়াত।
মূল বাড়ি থেকে বের হয়ে এবার শ্মশানে চলে আসুন। এখানে সমাহিত রয়েছেন জমিদার রাম মোহন রায়, কৃষ্ণমোহন রায়, গৌরি মোহন রায়সহ বহু জমিদার। তবে হিন্দুরীতি অনুযায়ী আগুনে দাহ না করে মাটি দেয়া হয় সাধু পুরুষ কমলাকান্ত রায়কে। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জালানো হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে সম্মান করত।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে কুমিল্লা অথবা কোম্পানীগঞ্জগামী বিভিন্ন বাস ছাড়ে। ময়নামতি সংলগ্ন ক্যান্টেনমেন্টে পৌঁছবেন কুমিল্লা শহরের আগে মাত্র ২ ঘণ্টায়। কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠলে আর বাস পরিবর্তন করতে হবে না। কুমিল্লার বাসে উঠলে ময়নামতিতে নামতে হবে। এখান থেকে আবার কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠে দেবিদ্বারের পান্নারপুলে নামতে হয়। সেখান থেকে বাখরাবাদ রোডে ১০ কিলোমিটার গেলেই জাহাপুর জমিদার বাড়ির অবস্থান।