ব্যস্ততার নান্দনিক শহর বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সৃজনশীল চর্চার চারণ ক্ষেত্র হিসেবে ইতোমধ্যে চেরাগি পাহাড়(Cheragi Pahar) চত্বর পরিচিতি লাভ করেছে। এলাকাটি বর্তমানে চেরাগি মোড় নামেই পরিচিত। সময়ের সাথে নানা বয়সের জ্ঞানমনষ্ক মানুষের আনাগোনায় নিত্য সরগরম হয়ে ওঠে এই চেরাগী পাহাড় চত্বর। এখানে কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যজন, শিল্পী, গায়ক, সৃজনশীল বইপত্রের পাঠক, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিককর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আনাগোনা ও আড্ডায় মুখরিত হয়ে থাকে পুরো এলাকার পরিবেশটি। সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এ ঐতিহ্যকে ধারণ করে সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ও কিঞ্চিৎ হলেও উপস্থিত হয়ে স্বস্তি খুঁজে নিতে সকাল-সন্ধ্যা কিচির মিচির গুঞ্জনে পুলকিত হয়ে ওঠে এলাকাটি। চেরাগি পাহাড়ের অবস্থান ডিসি হিলের উত্তর পাশে মোমিন রোড এবং জামাল খান রোডের সংযোগ স্থলে। তাই চতুর্দিকের পেশাজীবী, চাকরীজীবী, শিক্ষক-ছাত্র হতে শুরু করে মননশীল মানুষের মিলনের মোহনায় পরিণত হয়ে ওঠে। এছাড়াও বিভিন্ন মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রধান অফিস ও ব্যুরো কার্যালয় থাকায় সংপত্রসেবীদের কাছে এই স্থানটি বিশেষভাবে আকৃষ্টের উপকরণ। চিত্ত ও মননের এক নান্দনিক মালঞ্চ হিসেবে এখানে সব সময় বিরাচিত ফুলেল মৌ মৌ সৌরভ। তাই বিস্তর পরিসর না হলেও স্বল্প পরিসরে এই এক চিলতে আঙিনা মরুময় প্রান্তরে মরুদ্যানের মতই। নাগরিক জীবনের ইটপাথরের কাঠিন্যের মধ্যেও এখানে মননের সবুজ সজিবতার এক মোহময় আবেশ ছড়িয়ে থাকে অষ্টপ্রহর। মানুষের সৃজন কর্মের বিকাশে চেরাগি পাহাড় এলাকাটি সৃষ্টিসুখের নেশায় বিভোর; এখানে বেলা-অবেলায়, খেয়ালে-বেখেয়ালে আগন্তুকদের সময় গড়ায়। ক্রমশ সবার মাঝে বাড়ছে চেরাগি মোড়ের সম্মোহনী টান।
পূর্বে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আরব দেশ হতে সুফি সাধক হযরত বদর আউলিয়া (র.) সমুদ্রে ভাসমান এক খণ্ড পাথরের উপর আরোহন করে চট্টগ্রামে আসেন। তখন চট্টগ্রাম শহর ছিল জন-মানবহীন গভীর পাহাড় পর্বতে ঘেরা এবং জ্বীন-পরীদের বাসস্থান। হযরত বদর আউলিয়া (র.) একটি অলৌকিক মাটির চেরাগ হাতে নিয়ে গভীর বন-জঙ্গল দিয়ে একটি পাহাড়ের উপর উঠলে জ্বীন-পরীরা তাকে বাধা দেয় এবং বলে, তাদের আবাস স্থলে কোন মানুষের স্থান নেই। রাতের অন্ধকার নেমে আসলে হযরত বদর আউলিয়া (র.) জ্বীন পরীদের নিকট শুধু চেরাগ রাখার স্থানটুকু চাইলে তারা সম্মতি জ্ঞাপন করে। তিনি অলৌকিক চেরাগ জ্বেলে দিলে তা থেকে তীব্র তেজ বিকিরণ করতে থাকলে জ্বীনপরীরা শরীরে প্রকট জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। অতঃপর এক পর্যায়ে তারা চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং আস্তে আস্তে এখানে মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। এভাবেই চেরাগ রাখার পাহাড় চেরাগী পাহাড় নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রতীকী অর্থে এখান থেকে চেরাগ জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিল চট্টগ্রাম এবং সেই থেকে আজ অবধি চট্টগ্রাম আলোকিত হয়ে উঠছে ক্রমাগত।
হরেক রকম হাট : অসংখ্য দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, প্রকাশনা সংস্থা, মুদ্রণ, হকার সমিতির পাশাপাশি রয়েছে এলাকার আশেপাশে সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান, ব্যান্ড দল, ব্যাংক-বীমা, অ্যাডফার্ম, স্টেশনারি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র, হাসপাতাল, মন্দির, হল সর্বোপরি সকল প্রকার বাণিজ্যিক, সমাজকল্যাণমূলক ও শিল্প সাহিত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিনই ছুটে আসছে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে শহর বন্দর গ্রামগঞ্জ হতে শত শত হাজার হাজার মানুষ। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের অন্যতম এ চেরাগী পাহাড়ে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার। যেখানে ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও চেরাগী পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য, ক্লিনিক, হসপিটাল, ডায়াগোনস্টিক সেন্টার, কোচিং সেন্টার। অপর দিকে বেকারত্বের চাহিদা পূরণ ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ এ জায়গা থেকে উঠে আসছে বলে ধারণা করা যায়।
সন্ধ্যা হলেই আড্ডা জমায় ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণীর পাশাপাশি সব বয়সী মানুষ, আড্ডার ফাঁকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চটপটি, ফুচকা আর চা-পান তো রয়েছেই। মিডিয়াপাড়া হিসেবে খ্যাত চেরাগি পাহাড়ের আড্ডায় চলে সমালোচনা, আলোচনা, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, সঙ্গীত, কবিতাপাঠ, উপস্থিত হয় সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, বাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সর্বোপরি সকল শ্রেণীর মানুষ। সবকিছু মিলিয়ে এলাকার ঐতিহ্য ও নান্দনিকতার ধারা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর ক্রমাগত আধুনিক হয়ে উঠছে ব্যস্ততম চেরাগী পাহাড় এলাকার চেহারা।
মধ্য রাতেও মুখর চেরাগি : রাত ২টা ৩টার আড্ডারুরা ভিন্ন ক্যাটাগরির হয়। পত্রিকা ও প্রেসের কর্মীরা সামান্য স্বস্তিতে øান করতে চেরাগি মোড়ে আড্ডা জমায় নির্জন রাতে। সব দোকানপাট খোলা না থাকলেও যে দুয়েকটা খোলা থাকে সেদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রঙিন চা-বিস্কিট আর একটা সিগারেটের জন্য। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আড্ডাটা মোড় অন্য দিকে। ধীরে ধীরে কমে আসে চেরাগির কোলাহল।
প্রকাশনা সংস্থা ও বইঘর : প্রকাশনা সংস্থাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকদের আনা-গোনায় জমে উঠে চেরাগির আড্ডা। আর প্রকাশনা সংস্থা শৈলী প্রকাশন, আবীর প্রকাশন, নন্দন, শব্দচাষ, বলাকা প্রকাশন তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। এছাড়াও অভিজাত বুকস্টলÑ বাতিঘর, নন্দন, অদূরে রয়েছে প্রথমা, গ্রন্থনিলয়। বইপ্রেমী মানুষের আড্ডাস্থলের পাশাপাশি পাঠকের সৃজনশীল ও মূল্যবান বইয়ের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। কিছুদূর কথাকলি নামের বইয়ের দোকানটি কালের সাক্ষী হয়ে নীরবে বসে রয়েছে।
ফুলের রাজ্য, এবং… : অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চেরাগী পাহাড় এলাকাটির অন্যতম নান্দনিক পরিবেশে রূপ দিয়েছে এলাকার ফুলের দোকানগুলি। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা। দেখলে মনে হবে এ যেন পুরোটায় ফুলের রাজ্য। যদিও মাঝে মাঝে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও যানজট সৃষ্টি করে। তবুও ফুলের সুবাসে মুগ্ধ করে রাখে সবাইকে। আবার সামনে হাসপাতাল, ঔষধের দোকান; রয়েছে গার্মেন্টস। গার্মেন্টস এর তৈরি পোশাকগুলো রপ্তানি হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। আর পত্রিকা অফিসগুলো রাজ্যের খবর বিলি করে বেড়ায় দেশব্যাপি। অবশ্য পত্রিকা অফিস ও সাংবাদিকদের ভূমিকাটাই চেরাগি মোড়ের আসল প্রাণ। কবি-সাংবাদিক এবং সংস্কৃতিসেবিরাই যেন চেরাগি মোড়ের নিত্য সহচর। এরা যেন একে অপরের দোসর। ওদিকে, ডিসি হিলের মধ্যে নিঝুম থাকার কিছু সময়ও পাওয়া যায়। পাওয়া যায় অতি আপন জনের ঘনিষ্ঠ সাহচার্যও। হোক না তা অল্প সময়ের জন্য হলেও। অফিসে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠার আগেই ‘তাকে’ এক নজর দেখার সুযোগ করে দেয় ডিসি হিল। অবশ্য এখানে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানও হয়। অধিকাংশ অনুষ্ঠানই বাংলা ও বাঙালিকে ঘিরে, বাংলা সংস্কৃতির লালনের জন্য। বলতে গেলে, নগরকে মোহিত করে রাখে এই সামান্য সবুজ পাহাড়। এ উপত্যকার একটি প্রান্ত চেরাগি পাহাড়। যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল।
মিলনায়তন : চেরাগিকে ঘিরে রয়েছে ‘মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মেমোরিয়াল হল’। যেখানে প্রায় অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নাট্যকর্মীদের রিহার্সেলের ব্যস্ততা। ফলে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি জমজমাট পরিবেশ সৃষ্টি হয় এলাকাটিতে।
নাট্যদল :চেরাগি সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু নাট্যদলও। এদের পদচারণায় বেড়ে গেছে চেরাগি প্রাণচাঞ্চল্য। নাট্য দলগুলোর মধ্যে চোখে পড়ে- বিনোদিনী, ফেইম, লোক থিয়েটার, প্রতিনিধি, প্রতিভাস, ইত্যাদি।
আবৃত্তি সংগঠন : কম যায় না আবৃত্তি সংগঠনগুলোও। আড্ডা জমায় বোধন, প্রমা, ত্রিতরঙ্গ, কিংবদন্তি, অনার্য অন্যস্বর, শব্দ নোঙরের সদস্যরা।
গান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন : চারণ, উদীচী, সমগীত, অবসর, লোক সাং®কৃতিক মঞ্চ ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যপড়–য়া তরুণ-তরুণী : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়টা চট্টগ্রাম শহরের একটু দূরেই বটে, তবে চট্টগ্রাম শহর থেকেও প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যান অনেক শিক্ষার্থী। ক্লাস বন্ধ, কিংবা বিশেষ সময় সুযোগ পেলেই সহপাঠি অথবা পরিচিত তরুণ-তরুণীরা ঢু’মারেন চেরাগিতে। কথাবার্তা, ভাব-বিনিময় ছাড়াও কিছুটা সংস্পর্শে আসতে পারাটাই মুখ্য। পাছে দু’একটা বই কেনা আর কি! আবার তারা জম্পেশ আড্ডায় মেতে উঠে নন্দন, বাতিঘরের সামনে।
লিটলম্যাগ কর্মী : নতুন কোন্ বইটি বাজারে এসেছে, কোন্ লিটলম্যাগ এসেছে, কারা লিখেছে, বিভিন্ন কাগজের আলোচনা সমালোচনার আড্ডায় মুখরিত করে রাখেন লিটল ম্যাগ কর্মীরা। নতুন নতুন চিন্তার সমন্বয় নিয়ে কথা, বড় কাগজ- ছোট কাগজ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেগেই আছে।
রাজনৈতিক নেতাকর্মী : প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার প্রগতিশীল অনেক মানুষও চেরাগিতে আসেন তাদের সময় করে। একটু সুযোগ পেলেই তারা প্রাণের টানে ছুটে যান চেরাগি মোড়ের নির্ধারিত কিছু বইয়ের দোকানে। আর তারা হলেন- বদরুদ্দীন ওমর, আনু মুহাম্মদ, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, দিলীপ বড়–য়া প্রমুখরা।
চেরাগিকে প্রতিষ্ঠা করতে… : চেরাগি মোড়ের সৃজনশীল এ আড্ডাকে স্থায়ীভাবে রূপ দিতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ‘ইউনিটি ইন চেরাগি আড্ডা’। সম্প্রতি এ সংগঠনের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম আড্ডারু সম্মিলন। এ সংগঠন উঠে পড়ে লেগেছে চেরাগি মোড়ের হরেক রকমের অথচ সৃজনশীল এতসব কর্মকাণ্ডকে আরও এগিয়ে নিতে।
এবং অতঃপর… : এলাকায় বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো আরো বেশি মুগ্ধ করে আগত মানুষদের। নিয়মিত যদি এলাকায় এ সমস্ত সৃজনশীল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বইমেলার আয়োজন করা হয় তাহলে এলাকাটির পরিবেশ আরো সমৃদ্ধ হবে। সুস্থ সুন্দর পরিবেশের ধারাটি আরো অব্যাহত থাকবে। চট্টগ্রামের সকল সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের চর্চা কেন্দ্র হিসেবে চেরাগির যে পরিচিতি রয়েছে তা অক্ষয় থাকুক।
কিভাবে যাবেন
চেরাগী পাহাড় চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক স্থান।