১৯৬৩ সালের ৩১শে মার্চ কর্ণফুলি নামে একটি ফেরি সার্ভিস দিয়েই আরিচা-দৌলতদিয়া নৌরুটের যাত্রা শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্রুত বাড়তে থাকে আরিচা ঘাটের (Aricha Ghat) গুরুত্ব। এক পর্যায়ে আরিচা ঘাটকে নৌবন্দরের মর্যাদা দেয়া হয়। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার যানবাহন পারাপার হতো। যাতায়াত ছিল গড়ে ৫০ হাজার মানুষের।
কেমন ছিল আরিচা ঘাট আর যেমন আছে পাটুরিয়া ঘাট। দুই ঘাটের চিত্র এখন দুই রকমের। একটির জন্ম ৬০’র দশকে আর আরেকটির জন্ম ৯০ দশকে। উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের লাখো মানুষের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ছিল আরিচা ঘাট। আর যমুনা সেতু এবং আরিচা থেকে ঘাটটি পাটুরিয়ায় স্থানান্তর করার পর মরে যায় আরিচা আর প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে আসে পাটুরিয়া ঘাটে।
আরিচা ঘাট: এক সময়কার চিরচেনা সেই আরিচা ঘাট আজ শুধুই স্মৃতি। এই নামটি এখন শুধুমাত্র কালের সাক্ষী হয়ে মানুষের মনে গেঁথে আছে। ৯০ দশকের আগে দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ঘাটটি। বারো কিসিমের মানুষের আয়-রোজগারের এই আরিচা ঘাটে নেই রাতের আঁধারে ফেরির সেই সার্চ লাইটের আলোর ঝলকানি, নেই যাত্রী, হকার ও ফেরিওয়ালাদের হৈ-হুল্লোড়। হোটেল- মোটেল ও বোর্ডিংয়ের রমরমা ব্যবসাও নিভে গেছে এই ঘাট থেকে।
ঐ সময় এই আরিচায় গড়ে উঠে বিশাল দুটি ট্রাক টার্মিনাল। এই টার্মিনালের ধারণক্ষমতা ছিল এক হাজার ট্রাকের। এর ওপর যানবাহনের চাপে যানজট ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। ঐ সময় যানজটের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো যাত্রীদের। আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস পারাপার করা হলেও তিন চার দিন পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে আরিচা ঘাটের ট্রাক টার্মিনালে অপেক্ষায় থাকতে হতো। এমনকি সেখানে যানজটের মাত্রা এতোই ভয়াবহ ছিল যার কারণে ঈদের সময় ঘাটেই নামাজ পড়তে হয়েছে ঘরমুখো যাত্রীদের।
এছাড়া, এই আরিচা ঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ওপর নির্ভর করে ঘাটে গড়ে উঠেছিল শতাধিক আবাসিক হোটেল। ঘাটে কুলি ছিল হাজারেরও বেশি। সহস্রাধিক ফেরিওয়ালা ও হকারদের কোলাহল ছিল। সব মিলিয়ে আরিচা ঘাটকে ঘিরে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। কিন্তু এক সময়কার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আরিচা ঘাটে নেমে এসেছে সুনশান নীরবতা। বন্ধ হয়ে যায় শত শত হোটেল-রেস্টুরেন্ট। ধস নেমে আসে বোর্ডিং ব্যবসায়। আর বেকার হয়ে পড়ে শত শত কুলি। হকাররা বাধ্য হয়ে পাটুরিয়া ঘাটে অবস্থান নিয়ে কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এছাড়া যেখানে একসময় আরিচা টার্মিনালে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতো ট্রাকের বহর, এখন সেখানে গরুর খোঁয়াড়।
পাটুরিয়া ঘাট: ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের গুরুত্ব কমে যায়। তার ওপর আরিচা ঘাটের কাছে যমুনা নদীতে নাব্য কমে যায়। এরপর সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২০০২ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আরিচা ফেরিঘাট নিয়ে যাওয়া হয় পাটুিরয়াতে। এরপর থেকে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় পাটুরিয়া ঘাট। আরিচা থেকে দৌলতদিয়া ঘাটের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার থাকলেও পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া ঘাটের দূরত্ব অর্ধেকে নেমে আসায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সময় অনেকটাই কমে গেছে।
প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর পাটুরিয়া ঘাটে এখন বার কিসিমের মানুষের আয় রোজগারের একটি মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছে। ১৮টি ফেরি এবং ৩৩টি লঞ্চ চলাচল করছে এখানে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ হাজার যানবাহন পারাপার হচ্ছে ফেরিতে। আর লাখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পাটুরিয়া ঘাট।
বিপুল সংখ্যক খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসার প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। হাজারো কুলি আর ফেরিওয়ালাদের চেঁচামেচিতে মুখর থাকছে দিন-রাত সর্বক্ষণই। আর প্রতিনিয়তই যানজটে নাকাল হয়ে পড়ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। কখনও নাব্য সংকট, আবার কখনও ফেরি সংকট আবার কখনও বা নদীর স্রোত এবং ঘনকুয়াশাকে পুঁজি করে মানুষ ভোগান্তির এই পাটুরিয়া ঘাটকে ঘিরে চলে বারো কিসিমের মানুষের ভালো-মন্দ ধান্দাবাজি। তবে মানিকগঞ্জের মানুষের আশা এবং স্বপ্নের কথা হচ্ছে পাটুরিয়া ঘাট সংলগ্ন পদ্মার পাড়ে তৈরি হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের একটি স্টেডিয়াম। জায়গা সিলেকশন এবং দফায় দফায় দেশি-বিদেশিদের পরিদর্শন ইতিমধ্যে দেখা গেছে পাটুরিয়ায়।