গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের খন্ড খন্ড শাল বনের ৪৯০৯.০ একর বন ভূমি ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক বা গাজীপুর সাফারী পার্ক (Bangabandhu Sheikh Mujib Safari Park)।
বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক বা গাজীপুর সাফারী পার্কটি দক্ষিণ এশীয় মডেল বিশেষ করে থাইল্যান্ডের সাফারী ওয়ার্ল্ড এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার বালি সাফারী পার্কের কতিপয় ধারনা সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
সাফারী পার্কের চারদিকে নির্মাণ করা হচ্ছে স্থায়ী ঘেরাা এবং উহার মধ্যে দেশী/বিদেশী বন্যপ্রাণীর বংশবৃদ্ধি ও অবাধ বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে পর্যটকগণ চলমান যানবাহনে অথবা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করে শিক্ষা, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ লাভ করবেন।
সাফারী পার্কের ধারনা চিড়িয়াখানা হতে ভিন্নতর। চিড়িয়াখানায় জীবজন্তুসমূহ আবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং দর্শনার্থীগণ মুক্ত অবস্থায় থেকে জীবজন্তু পরিদর্শন করেন। কিন্তু সাফারী পার্কে বন্যপ্রাণীসমূহ উন্মুক্ত অবস্থায় বনজঙ্গলে বিচরণ করবে এবং মানুষ সতর্কতার সহিত চলমান যানবাহনে আবদ্ধ অবস্থায় জীবজন্তুসমূহ পরিদর্শন করবেন।
বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক বা গাজীপুর সাফারী পার্কটি ৫টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। ১. কোর সাফারি। ২. সাফারি কিংডম। ৩. বায়োডাইভার্সিটি পার্ক। ৪. এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক। ৫. বঙ্গবন্ধু স্কয়ার।
১. কোর সাফারি
কোর সাফারী পার্ক কোর সাফারী পার্কে সাফারী গাড়ী ব্যতীত কোন পর্যটক প্রবেশ করতে পারবেন না তবে তিনি বন্যপ্রাণী বেষ্টনীতে মুক্ত অবস্থায় প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণরত বন্যপ্রাণী সমূহ গাড়ীতে চড়ে অবলোকন করতে পারবেন।
কোর সাফারী পার্ক ১৩৩৫ একর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হবে-যার মধ্যে ২০.০ একরে বাঘ, ২১.০ একরে সিংহ, ৮.৫০ একরে কালো ভালুক, ৮.০ একরে আফ্রিকান চিতা, ৮১.৫০ একর চিত্রা হরিণ, ৮০.০ একরে সাম্বাব ও গয়াল, ১০৫.০ একরে হাতী, ৩৫.০ একরে জলহস্তী, ২২.০ একরে মায়া ও প্যারা হরিণ, ২৫.০ একরে নীলগাই এবং বারো সিংগা, ১১৪.০ একরে।
২. সাফারি কিংডম
সাফারী কিংডমে পর্যটকগণ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারবে এবং প্রাণিকূলকে ছোট-খাট বেস্টনীর মধ্যে আবদ্ধ রাখা হবে। সাফারী কিংডমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে: বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নৈপূণ্য ও খেলাধুলা প্রদশর্ণের মাধ্যমে পর্যটকদের চিত্তবিনোদন, বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।
সাফারী কিংডম ৫৭৫.০ একর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র, জিরাফ ফিডিং স্পট, পেলিকেন আয়ল্যান্ড, বোটিং ও লেকজোন; বৃহৎ আকারের গাছপালা ঘেরা ক্রাউন্ট ফিজেন্ট এভিয়ারী, ধনেশ এভিয়ারী, প্যারট এভিয়ারীসহ দেশি-বিদেশী পাখির পাখীশালা (আরধৎু), কুমির পার্ক, অর্কিড হাউজ, প্রজাপতি কর্ণার, শকুন ও পেঁচা কর্ণার, এগ ওয়ার্ল্ড, কচ্ছপ-কাছিম ব্রিডিং সেন্টার, লামচিতা হাউজ, ক্যাঙ্গারু বাগান, হাতী-শো গ্যালারী, ময়ুর/মেকাউ ওপেন ল্যান্ড, সর্প পার্ক, ফেন্সি কার্প গার্ডেন, ফেন্সি ডার্ক গার্ডেন, লিজার্ড পার্ক, ফুডকোটর্ , পর্যবেক্ষন টাওয়ার ও জলাধার ইত্যাদি।
৩. বায়োডাইভারসিটি পার্ক
এই পার্ক প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিরল, বিলুপ্তপ্রায়, দূলর্ভ ও বিপন্ন প্রজাতির গাছের জীন-পুল সংরক্ষণ করা। এছাড়া এ পার্কে শালবন এবং জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্তে উপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হবে। এ পার্কটিকে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও বলদা গার্ডেনের র্যাপলিকা হিসাবে স্থাপন করা হবে। বায়োডাইভারসিটি পার্কের এলাকা নিধারণ করা হয়েছে ৯৬৫.০ একর।
৪. এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারী পার্ক
এই পার্কে সকল এশীয় তৃনভোজী এবং ছোট মাংসাশী প্রাণি, পাখি, সরিসৃপ ও উভচর প্রাণি নিয়ে এক্সটেনসিভ সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। বন্যপ্রাণির আবাসস্থালের জন্য উপযোগী চারণ ভূমি, বন বাগান, জলাধার, ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যমান প্রাকৃতিক বনভূমির উন্নয়ন করা হবে। এই পার্কের এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮২৪ একর।
৫. বঙ্গবন্ধু স্কয়ার
পার্কের প্রবেশ পথে পার্কিং এলাকা, বিনোদন উদ্যান ও প্রশাসনিক কাজে ৩৮ একর এলাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে বিশাল পার্কিং এলাকা। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে আকর্ষণীয় মুরাল ও মডেলসহ প্রধান ফটক, ফোয়ারা, জলাধার ও লেইক।
তথ্যকেন্দ্র, পার্ক অফিস, ডরমেটরি, বিশ্রামাগার, নেচার হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ঐরাবতী বিশ্রামাগার, ময়ূরী বিশ্রামাগার, ইকো-রিসোর্ট, ডিস্প্লে ম্যাপ, আরসিসি বেঞ্চ ও ছাতা।
এছাড়াও রয়েছে দুটি বিশাল আকার পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ, একটির নাম টাইগার রেস্তোরাঁ অপরটি সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ। এই দুটো রেস্টুরেন্টে বসেই কাচের মধ্যে দিয়ে সিংহ এবং বাঘ দেখতে দেখতে খাওয়াদাওয়া করা যাবে।
বিরল প্রজাতির কিছু বন্য প্রাণি আছে যেগুলো কখনও এশিয়া অঞ্চলে সচরাচর দেখা যায় না। এগুলোর মধ্যে আল পাকা, ক্ষুদ্রকায় ঘোড়া, ওয়ালাবি, ক্রাউন ক্রেইন, মান্ডারিং ডাক ইত্যাদি।
পার্কে প্রবেশ ফি
প্রাপ্ত বয়ষ্ক জন প্রতি পার্কে প্রবেশ টিকেট ৫০ টাকা এবং ১৮ বয়সীদের নিচে প্রবেশ ফি ২০ টাকা। শিক্ষা সফরে আসা বা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা।
গাড়িতে করে কোর সাফারি পার্ক পরিদর্শন প্রাপ্ত বয়ষ্কদের প্রতিজনের টিকিট ফি ১শ’ টাকা। অপ্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য ৫০ টাকা।
প্যাডেল বোট ভ্রমণ ৩০ মিনিট ২শ’ টাকা।
বাস পার্কিং ২শ’ টাকা। মিনি বাস বা মাইক্রোবাস পার্কিং ২শ’ টাকা। গাড়ি বা জিপ পার্কিং ৬০ টাকা। অটোরিকশা বা সিএনজি পার্কিং ৬০ টাকা।
কীভাবে যাবেন :
গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকে বাঘের বাজার গেলেই চোখের পড়বে সাফারি পার্কের বিশাল সাইনবোর্ড। বাঘের বাজার থেকে সাফারি পার্কের দরজা পর্যন্ত যেতে রিকশা ও অটোরিকশা পাওয়া যায়। ভাড়া নিবে ৫০ থেকে ৭০ টাকা।
গাজিপুর চৌরাস্তা থেকে বাঘের বাজার পর্যন্ত যাওয়ার জন্য রয়েছে হিউম্যান হলার। ছুটির দিন ও সাধারণ দিন হিসেবে ভাড়া মান নির্ভর করে। ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
এছাড়া ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাতায়াত করা বাসে করেও বাঘের বাজার সরাসরি নামা যায়।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য
- পার্ক খোলাঃ সকাল ৯ টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
- সাপ্তাহিক বন্ধঃ মঙ্গলবার।
- দুপুরের খাবারঃ ১৬০ টাকা (চিকেন বিরিয়ানি)
পর্যটকদের জন্য অনুসরণীয় :
১. পলিথিন ও অপচনশীল পদার্থ যত্র-তত্র না ফেলে ডাস্টবীনে রাখুন।
২. সিগারেটের প্যাকেট, পরিত্যক্ত কাগজ, নষ্ট ব্যাটারী, লাইটার ও বিস্কুট, চানাচুর প্রভৃতির প্লাস্টিকের মোড়ক যেখানে সেখানে না ফেলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা।
৩. বাঘ ও সিংহের বেস্টনীতে চলন্ত গাড়ী হতে না নামা।
৪. কোমল ও বিশুদ্ধ পানীয় বোতল জঙ্গলে না ফেলা।
৫. মাইক বাজানো, বাজি বা পটকা ফোটানো, গান-বাজনা ও দলবদ্ধভাবে হৈ-চৈ না করা।
৬. বিশ্রামাগার ব্যবহার করতে হলে আপনাকে পূর্ব থেকে বুকিং নিতে হবে।
৭. পূর্বেই টিকেট কাউন্টার হতে টিকেট ক্রয় বাঞ্চনীয়।
৮. বন্যপ্রাণীকে যেকোন ধরণের খাবার প্রদান থেকে বিরত থাকবেন।
৯. বাইরের কোন খাবার পার্কের ভিতরে না নেওয়া।
পরিবার নিয়ে ভ্রমণের প্রতীক্ষায়।
সহসাই ভ্রমণ করার ইচ্ছা রয়েছে। সব তথ্য সরবরাহ করায় ভ্রমণ নিশ্চয়ই আরামদায়ক হবে বলে মনে করছি।