জাতীয় সংসদ ভবন(Jatiya Sangsad Bhaban) রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ একটি নিদের্শন। পিরামিডের সময় থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ব্যাপ্ত স্থাপত্য সমূহের যদি একটি বাছাই তালিকা করা হয় তবে তাঁর মাঝেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন উপরের সারিতেই স্থান পাবে। বলা যায়, এটি আধুনিক যুগের স্থাপত্য রীতির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন এবং এর মাধ্যমে সূচিত হয় আধুনিকোত্তর যুগের স্থাপত্য রীতির। এ অসাধারণ ভবনটি আমেরিকার স্থাপতি লুই আই কান-এর সৃষ্টিশীল ও কাব্যিক প্রকাশের নিদর্শন। যার জন্য ঢাকার ভ্রমন শুরু করলে প্রথমে যে কেহ রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকার কথা ভাবেন।
জাতীয় সংসদ ভবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বিশালত্বের মাঝে নিহিত। মার্বেল পাথর সংযুক্ত বিপুল কংক্রিটের বহির্দেয়ালের মাঝে মাঝে রয়েছে নিখুঁত জ্যামিতিক আকৃতির প্রবশদ্বার। বৃত্তাকার ও আয়তাকার কংক্রিটের সমাহার ভবনটিকে দিয়েছে এক বিশেষ স্থাপত্যিক সৌকর্য যা এর মহান উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভবনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে হলো সংসদের প্রধান হল, যেখানে সংসদ সদস্যগণ পার্লামেন্টে বসেন। সমকেন্দ্রিক নকশার মূল হলরুমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অংশগুলি গড়ে উঠেছে। ছাদ দিয়ে প্রবেশ করা আলোর মালা সাত তলা উঁচু গোলাকার মূল হলরুমটি এমনভাবে বেষ্টিত ঠিক যেন দেবীর মঞ্চকে ঘিরে উম্মুক্ত গোলাকার পথ। মূল ভবনের চারবাহু বরাবর চার কোণে অন্যান্য কাজের জন্য রয়েছে চারটি একই ধরনের অফিস ব্লক। যোগাযোগের জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সিড়ির ব্যবস্থা। বর্গাকার নকশার হলেও এটি নিপুণ ভাবে অষ্টভুজের মধ্য স্থাপিত হয়েছে। নয়তলা বিশিষ্ট হলেও অনুভূমিক যোগাযোগ রয়েছে মাত্র তিনটি তলায়। মাটির উপরে কাঠামোটির উচ্চতা ৪৯.৬৮ মিটার।
মূল ভবন কমপ্লেক্সটির নয়টি স্বতন্ত্র বিভাগে বিভক্ত। এর মধ্য আটটি ৩৩.৫৩ মিটার এবং কেন্দ্রীয় অষ্টভুজাকার ব্লকটি ৪৭.২৪ মিটার উঁচু। কেন্দ্রীয় ব্লকটি ৩৫৪ আসন ধারণক্ষম অ্যাসেম্বলি কক্ষ নিয়ে গঠিত। সমগ্র কমপ্লেক্সটির আয়তন (floor area) হলো মূল ভবনে ৭৪,৪৫৯.২০ বর্গমিটার, দক্ষিণ প্লাজায় ২০,৭১৭.৩৮ বর্গমিটার এবং উত্তর প্লাজায় ৬,০৩৮.৭০ বর্গমিটার। দক্ষিণ প্লাজার মূল প্রবেশ পথটি একটি প্রশস্ত সিঁড়ির আকারে ধীরে ধীরে ৬.২৫ মিটার উচ্চতায় উঠে গেছে। এর বেসমেন্টে রয়েছে পার্কিং এলাকা, তত্ত্বাবধায়ক এজেন্সির অফিস ও মূল ভবনের সুবিধাদি প্রদানের জন্য স্থাপিত বিভিন্ন ব্যবস্থা। একটি কৃত্রিম লেক ভবনের চার পাশের প্রাচীর ঘিরে আছে এবং এটি উত্তর ও দক্ষিণ প্লাজাকেও সংযুক্ত করেছে। সমস্ত ভবনটাকে মনে হয় যেন পানির উপরে ভেসে উঠেছে। র্পালামেন্ট ভবনে প্রবেশের জন্য রয়েছে দক্ষিণের গ্র্যান্ড প্লাজা ও উত্তরে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত বাগান ও ইউক্যালিপটাসের সারি শোভিত প্রেসিডেন্সিয়াল স্কয়ার। উত্তর প্রবেশ পথের দিকে রয়েছে একটি এ্যাম্পি থিয়েটার যেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উত্তর প্লাজা পেরিয়ে ক্রিসেন্ট লেকের পাশে রয়েছে একটি রাস্তা।
ভবনের কোথাও কোনো কলাম নেই। শূন্য স্থানের অংশ হিসেবে ফাঁপা কলাম রয়েছে ঠিকই কিন্তু তা শুধুই কাঠামো নকশায় ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যবহূত হয়েছে। এটি অনেকটাই বিশাল কংক্রিটকে খোদাই করে পরিণত করা হয়েছে একটি অসাধারণ কার্যকর ভাস্কর্যে। নির্মাণ মসলা হিসেবে কংক্রিট ব্যবহূত হয়েছে এবং ভেতরে ও বাইরের অংশে ব্যবহূত হয়েছে ঢালাই কংক্রিট। যে দক্ষতার সাথে আলোকে প্রয়োগ করা হয়েছে তাই হলো কান-এর নকশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ছাদ দিয়ে প্রবেশকৃত আলো বিভিন্ন জায়গাকে যেভাবে আলোকিত করেছে তাতে মনে হয় আলোকচ্ছটা ঝরে পড়ছে স্বর্গ থেকে।
জাতীয় সংসদ ভবনের নকশায় সূর্যের আলো এবং বৃষ্টির প্রতিরোধকে বিবেচনা করা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। অন্যদিকে বাতাসের বাধাহীন চলাচলকে সম্ভব করেছে বহিস্থ ফাসাদের বিশাল জ্যামিতিক ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র, সম্পূর্ণ বৃত্ত ও বৃত্তাংশ এবং সমতল খিলানসমূহ। ভবন কাঠামোটি একটি অসাধারণ সৌধ হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে বাইরের দিকে গতাণুগতিকভাবে জানালা স্থাপন পদ্ধতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মূল দেওয়ালে ফাঁক সৃষ্টি করে বিশাল স্থাপত্যের অসুবিধাকে দূর করা হয়েছে। স্থাপত্যিক শৈলীতে ভবনটি ঢাকার আধুনিক ভবনসমূহ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করার নিয়মাবলীঃ
জাতীয় সংসদ ভবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য সবার জন্য উন্মুক্ত, যে কেহ বাহির থেকে এর সৌন্দর্য্যৈউপভোগ করতে পারবেন। জাতীয় সংসদ ভবনের ভিতরের অংশ সপ্তাহের রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে পরিদর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সপ্তাহের এই দিনগুলিতে নির্দিষ্ট নিয়মাবলী মেনে কেউ চাইলে জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করতে পারেন।
সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রেঃ যে কোন বাংলাদেশী নাগরিক জাতীয় সংসদ ভবন বিনামূল্যে পরিদর্শন করতে পারে। এই জন্য তাকে কিছু নিয়মাবলী পালন করতে হয়। প্রথমত একজন সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশ সংসদ সচিবালয়ের সচিবের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে যে কেউ জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করতে পারবে।
গবেষকের ক্ষেত্রেঃ কোন গবেষক চাইলে তাঁর গবেষণা কার্যের জন্য জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশ সংসদ সচিবালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করতে হবে। পরবর্তীতে আবেদনের প্রেক্ষিতে অনুমতি প্রদান সাপেক্ষে তিনি জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করতে পারবেন।
বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রেঃ আমাদের দেশে আগত বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা চাইলে কিছু ফি এর বিনিময়ে জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করতে পারেন। পরিদর্শনের জন্য বিদেশী নাগরিকদের জনপ্রতি ৬০০ বাংলাদেশী টাকা প্রদান করতে হবে। এর পাশাপাশি তাদেরকে একটি ফরম পূরণ করতে হবে এবং তাদের পাসপোর্ট ও ভিসা এর ফটোকপি জমা দিতে হবে।
জাতীয় সংসদ ভবন কিভাবে যাবেন –
ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে সি এন জি ইত্যাদিতে চড়ে সংসদ ভবন এর কথা বললে পৌঁছে দিবে আপনাকে । বাসে করে আসতে চাইলে যে কোন স্থান থেকে ফার্মগেইট আসতে হবে। ফার্মগেইট থেকে হেটে কিংবা রিক্সা করে জাতীয় সংসদ ভবন যাওয়া যায়।