রাতারগুল জলাবন – সিলেট

নিঝুম ঝকঝকে দুপুর। তটিনীর কূলে ডেকে যায় একলা ডাহুক। এমন নিস্তব্ধ দুপুরে শুধু নৌকার বৈঠা শব্দ করছে ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। এমনই এক ঘোর মাখা সময়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বাংলার অ্যামাজন নামে পরিচিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুলে।

রাতারগুল আমাদের দেশের একমাত্র ‘ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট’ বা জলাবন। সিলেট থেকে দেশের একমাত্র স্বীকৃত এই সোয়াম্প ফরেস্টের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এই জলাবনের অবস্থান।

উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর। মাঝখানে ‘জলাবন’ রাতারগুল(Ratargul Jolabon)। উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে এর দুটি, একটা শ্রীলংকায় আর আরেকটা আমাদের রাতারগুলে।

অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের। রেইন ফরেস্ট নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদুপানির সবচাইতে বড় সোয়াম্প বন কিন্তু ওই অ্যামাজনই। ঠিক অ্যামাজন সোয়াম্পের মতোই স্বাদুপানির বন আমাদের এই রাতারগুল।

সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই মুর্তা অথবা রাতাগাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। অ্যামাজনের মতোই গাছগাছালির বেশির ভাগ অংশই বছরে চার থেকে সাত মাস থাকে পানির নিচে। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখানকার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে পানিটা প্লাবিত করে পুরো রাতারগুল জলাবনকে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে ( মে – সেপ্টেম্বর)। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই, পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙ্গা। আর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়েচলা মেঠোপথ। আর তখন জলজ প্রাণীকুলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বড় বড় ডোবাগুলোতে।

বর্ষায় বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকই ডুবিয়ে আছে জলে। কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগবে পুরো বনটা। মাঝেমধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দিবে পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে পথ চলতে হয়। তবে বর্ষায় এ বনে চলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর।

বনবিভাগের তথ্যমতে- এই বনের আয়তন তিন হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে রয়েছে জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের পানি সহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে নির্বিষ গুইসাপ, জলঢোড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ উঠে পড়ে গাছের ওপর।

বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরো অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এই বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝেমধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পাখি। শুকনো মৌসুমে ডিঙ্গি নিয়ে ভেতরে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আপনাকে উড়ে সরে গিয়ে পথ করে দেবে। এ দৃশ্য আসলেই দুর্লভ!

গাছের মধ্যে এখানে করচই বেশি। হিজলে ফল ধরে আছে শয়ে শয়ে। বটও চোখে পড়বে মাঝেমধ্যে। আর বনের দক্ষিণে মুর্তা (পাটি) গাছের প্রাধান্য। রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। এ ছাড়া ওদিকে শিমুল বিল হাওর আর নেওয়া বিল হাওর নামে দুটো বড় হাওর আছে।

জলের নিচের অপূর্ব জগতঃ

বর্ষায় হাওরের স্বচ্ছ পানির নিচে ডুবে থাকা গাছগুলো দেখার অভিজ্ঞতা অপূর্ব। শীতকালে আবার বনের ভিন্নরূপ। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে মূর্তা ও জালি বেতের বাগান। সে সৌন্দর্য আবার অন্য রকম! বন এভাবে জলে ডুবে থাকে বছরে চার থেকে সাত মাস। বর্ষা কাটলেই দেখা যাবে অন্য চেহারা। তখন বনের ভেতরের ছোট নালাগুলো পরিণত হবে পায়ে চলা পথে। সেই পথ দিয়ে হেঁটে অনায়াসে ঘুরে বেড়ানো যায়।

রাতারগুল বনে ঢুকতে হয় ডিঙি নৌকায় চেপে। নৌকা একবার বনে ঢুকলেই আর কথা নেই ! দুটি মাত্র শব্দ লাগবে আপনার ভাব প্রকাশের জন্য, আপনি হয় তো বলে উঠবেন- “আমি মুগ্ধ” ! আর বোনাস হিসেবে পাবেন গোয়াইন নদী দিয়ে রাতারগুল যাওয়ার অসাধারণ সুন্দর পথ, বিশেষ করে বর্ষায়। এ ছাড়া নদীর চারপাশের দৃশ্যের সঙ্গে দেখবেন দূরে ভারতের মিজোরামের উঁচু সবুজ পাহাড়।

কিভাবে যাবেনঃ

রাতারগুল যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে। তবে যেভাবেই যান, যেতে হবে সিলেট থেকেই।

প্রথম উপায়- সিলেট থেকে জাফলং – তামাবিল রোডে সারীঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ৯০০ – ১৫০০ এর মধ্যে (আসা-যাওয়া) আর সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘণ্টাপ্রতি লাগবে ২০০-৩০০ টাকা।

দ্বিতীয় উপায় হলো- সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌঁছানো, ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট–শালুটিকর হয়ে যাওয়া এই রাস্তাটা বর্ষাকালে খুবই সুন্দর। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ৮০০ – ১৫০০ টাকার মধ্যে (আসা-যাওয়া) আর সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে মাঝি ঘণ্টাপ্রতি নেবে ২০০-৩০০ টাকা।

আরো একটি উপায়ে আপনি পৌঁছাতে পারেন রাতারগুল- সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মোটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌঁছাতে হবে, ভাড়া নেবে ২০০-৩০০ টাকা আর সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। এরপর মোটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়, এতে ঘণ্টাপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা লাগবে। এই তৃতীয় পথটিতেই সময় ও খরচ সবচেয়ে কম।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: সাফায়েত,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 27, 2018

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.