ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ী-মুন্সিগঞ্জ

ভাগ্যকুলের এই জমিদার বাড়ীটি(Bhaggyakul Zamidar Bari) বানিয়েছিলেন জমিদার যদুনাথ সাহা। দ্বিতল বাড়ীর সামনে রয়েছে আটটি বিশাল থাম, দেখতে অনেকটা মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার বাড়ীর মত। ভবনটির চারিদিকেই এমন থাম বিশিষ্ট এই স্থ্যাপত্যটি গ্রীক স্থাপত্যের ঘরনায় নির্মিত। ভবনের ভেতরে নকশা-সাপ, ময়ূর, ফুল, পাখি সহ নানান নকশা রয়েছে। পুরো জমিদার বাড়ীর আঙ্গিনা জুড়ে ভবন, মাঝে উঠোন। এই জমিদার বাড়ীর দরজা এবং জানালা একই মাপের, মানে উচ্চতার। ফলে কপাট বদ্ধ অবস্থায়, কোনটি দরজা, কোনটি জানালা বুঝা দায়। একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িটি কাঠের তৈরি। এই জমিদার বাড়ীটি বান্দুরায় অবস্থিত। জমিদার বাড়ীর সামনে রয়েছে “নবকুঠি”, এটি মূলত গদিঘর ছিল। এই জমিদার বাড়ীটি আনুমানিক ১৯২০ সালের আগে পড়ে নির্মাণ করা হয়। যদুনাথ সাহার ছিল পাঁচ ছেলেমেয়ে। এদেরকে পৃথক পৃথক বাড়ী নির্মাণ করে দেন জমিদার যদুনাথ, যেগুলো বান্দুরা’র কোকিলপেয়ারি জমিদার বাড়ী, উকিল বাড়ী, জজ বাড়ী নামে পরিচিত রয়েছে।

ভাগ্যকুলে জমিদারদের সাতটি হিস্যার সন্ধান পাওয়া যায়। গুরুন্ন প্রসাদের দুই পুত্র মথুরামোহন রায় এবং প্রিয় মোহন রায় এর উত্তরপুরম্নষ ভাগ্যকুলের বর্তমানের ওয়াপদায় বসতি স্থাপন করেন। এই পরিবাইে জন্মেছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেটার পংকজ রায়। পুলিন রায়ও জমিদার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।

হরিপ্রসাদ রায় ১৮২৯ সালে ওলাউঠাতে মৃত্যুবরণ করলে গুরুন্ন প্রসাদ রায় ভ্রাতার বংশ রক্ষার্থে তার কণিষ্ঠপুত্র হরলাল রায়কে ১৮৩০ সালে পৌষ্যপুত্র প্রদান করেন। তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধি থাকায় হরলাল ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতিলাভ করেন। কলকাতায় বহু বাড়ি ক্রয় ও নির্মাণ করেন। তিনি ব্যয়শীল ও দাতা হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু মাত্র ২৬ বৎসর বয়সে বসন্ত রোগে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রী মাণিক্যময়ী নিজের ৬ বছর বয়সী ছোটভাই হরেন্দ্রলালকে পৌষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। হরেন্দ্রলাল রায় ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ হরেন্দ্রলাল পাবলিক লাইব্রেরি, ভাগ্যকুল উপস্বাপস্থ্য কেন্দ্র, মুন্সীগঞ্জ হরেন্দ্রলাল কলেজসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। যদিও কলেজটি স্থানীয় দ্বন্দ্বে বিলুপ্ত হয়। সারাদেশব্যাপী অসংখ্য বিদ্যালয়, চেরিট্যাবল ডিস্পেন্সারী, মন্দির-বিগ্রহ, পানীয় জলের ট্যাংক, রেসকোর্স প্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। দানশীল ও রাজভক্তির জন্য সরকার ১৯১৪ সালে তাকে রায়বাহাদুর উপাধি দ্বারা ভূষিত করেন। তিনি নিজের স্টীমার ও ৩৫ হজার টাকার ওয়ারবন্ড ক্রয় করে যুদ্ধ ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় সরকারকে সহযোগিতা করেন। তিনি বৃটিশ ইন্ডিয়া এ্যাসোসিয়েশন, বেঙ্গল ল্যান্ড হোল্ডর এ্যাসোসিয়েশন, ইস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড হোল্ডার এ্যাসোসিয়েশন, নর্থব্রুক হল, কলকাতা কন্সটিটিউশনাল ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তিনি বেঙ্গল জমিদার সমিতির সহসভাপতি ও মিডফোর্ট হাসপাতালের লাইফ গভর্ণর ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে ৭৮ বৎসর বয়সে স্ত্রী ও তিনপুত্রের মৃত্যুর শোকে শোকাহত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

গঙ্গাপ্রসাদ রায়ের ৪র্থ ও কণিষ্ঠ পুত্র প্রেমচাঁদ রায়ের তিনপুত্র ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী জমিদার। এদের মধ্যে শ্রীনাথ রায় এবং জানকী নাথ রায় ইংরেজ সরকার কর্তৃক রাজা উপাধি দ্বারা ভূষিত হন। এই দুইজন ভাগ্যকুলে প্রাসাদ নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাদের প্রাসাদও প্রায় ৩০ বছর পূর্বে কৃত্তিনাশা পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। রাজা শ্রীনাথ রায় ছিলেন ভাগ্যকুলের জমিদারদের মধ্যে সর্বশেষ্ঠ। তিনি ১৮৪১ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে ঢাকা ও পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ঢাকার মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, রোডসেস ও শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি একনমিক মিউজিয়মের ও জুলজিক্যাল গার্ডেনের আজীবন গভর্ণর এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। রাজা শ্রীনাথ রায়, রাজা জানকীনাথ রায় ও রায় সীতানাথ রায় যৌথভাবে পূর্ব বেঙ্গল চক্ষু চিকিৎসালয়, সীতাকুন্ডু ওয়াটার ওয়ার্কস ও অন্যান্য বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করেন। তারা কলকাতার দরিদ্রদের জন্য একটি আদর্শ বস্তি বিল্ডিং নির্মাণ করেন। পূর্ববঙ্গ ও কলকাতায় তাদের বহু ব্যবসায় ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ছিল। কলকাতা ও ঢাকার একটি স্টীমার সার্ভিসও তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজভক্তি ও বহু জনহিতকর কাজের জন্য ১৮৯১ সালে রাজা উপাধীতে ভূষিত হন। তাদের ন্যায় ধনী বাঙ্গালি অতি অল্পই ছিল। সে সময় তাদের দানের পরিমান ছিল ৬ লক্ষ টাকার অধীক। সিরাজদিখানের রায় বাহাদুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং শ্রীনগরের রাজা শ্রীনাথ হাসপাতাল এখনো কালের স্বাক্ষী হিসাবে রয়েছে। বর্তমানে ভারতের বিখ্যাত সাহারা গ্রুপও রাজা শ্রীনাথ রায়ের উত্তর পুরুষ।

রাজা সীতানাথ রায়ের দুই পুত্র যদুনাথ রায় এবং প্রিয়নাথ রায়। যদুনাথ রায় বর্তমানের বাড়িখাল ইউনিয়নের উত্তর বালাশুরে (সে সময় ভাগ্যকুল নামে পরিচিত ছিল) হুবহু একই ধরণের দুটি ত্রিতল ভবন নির্মাণ করেন। বিশালাকৃতির দিঘি খনন করেন, নাট মন্দির ও দূর্গামন্দির স্থাপন করেন। ড. হুমায়ুন আজাদ এই বাড়িটিকে নিয়ে তার ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না গ্রন্থে লিখেছেন- বিলের ধারে প্যারিশ শহর। সাহিত্যিক নূর উল হোসেন তার বহু লেখায় ভাগ্যকুলের জমিদার বাড়ির জাকজমকপূর্ণ উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন। ভাগ্যকুলের স্টীমার ঘাটও সুপরিচিত ছিল জমিদারদের কারণেই। ইংরেজি গ্রামার বইয়ে ‘দি’ এর ব্যবহার শিখতে ‘ভাগ্যকুলের জমিদারগণ অনেক বড়’ বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ পড়তে হতো পাকিস্তান আমলেও। একবার মেট্রিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও বাক্যটি অনুবাদ করার জন্য ছিল। ভাগ্যকুলের জমিদারদের নিকট রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কুঠিবাড়ি বিক্রি করেছিলেন। কলকাতার বিখ্যাত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাও ভাগ্যকুলের জমিদারগণ। ভাগ্যকুরের জমিদারগণ শুধু শিক্ষানুরাগীই ছিলেন না, তারা প্রায় সকলেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। ঢাকা, কলকাতা এবং ইংল্যান্ডে তার পড়াশোনা করেন। বর্তমানে ভাগ্যকুলের র‍্যাব অফিসের নিকট তিনজন ব্যারিস্টারের সমাধীসৌধ রয়েছে। এছাড়া বটু মন্দির যার স্মৃতিতে তিনিও ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন।

ভাগ্যকুলের জমিদারদের সকলেরই কলকাতায় বাড়ি ছিল। তারা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ কলকাতামুখী হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র যদুনাথ রায় তার বিলের ধারের প্রাসাদে ছিলেন। তিনি ভাগ্যকুল ত্যাগ করতে চাননি। বৃদ্ধ বয়সে তার আত্মীয়-স্বজনরা জোর করে কলকাতায় নিয়ে যায়। তিনি কলকাতায় গিয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। যদুনাথ রায়ের বাড়িটি দীর্ঘদিন অযত্নে অবহেলায় পড়েছিল। পরিণত হচ্ছিল ধ্বংসস্তূপে। বর্তমানে “অগ্রসর বিক্রমপুর” এই বাড়িটি রক্ষায় এগিয়ে এসেছে এই প্রত্যয়ে যে, তারা ফিরিয়ে আনবে আগের অবয়ব। স্থাপন করবে বিক্রমপুর যাদুঘর ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, থাকবে পর্যটন কেন্দ্র, গেস্ট হাউজ, থীমপার্ক, নৌ-যাদুঘর ইত্যাদি। আবারো বিলের ধারের এ প্যারিস শহরটি জীবন ফিরে পাবে। লোক সমাগমে ভরে উঠবে। বিক্রমপুরের ঐতিহ্য এবং ভাগ্যকুলের জমিদারদের কৃত্তি অবলোকনে দূর-দূরান্ত হতে হাজার হাজার মানুষ ভাগ্যকুলে আসবে। পূরণ হবে বিক্রমপুরবাসীর একটি দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: ভ্রমণ পাগল,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 9, 2018

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.