বার আউলিয়া মাজার – পঞ্চগড়

পঞ্চগড় জেলায় বেশ কয়েকটি মাজার এই জনপদের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে অভিভুত ও পবিত্র করে তোলে। বিখ্যাত সুফী ও পীর দরবেশগণের পবিত্র চরণ এই অঞ্চলের ধূলি মাটিকে ধন্য করেছে। ব্যাপক ধর্মীয় প্রচার এ অঞ্চলে অনেক পরে হয়েছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলাধীন ‘বার আউলিয়ার’ মাজার(Bar Awlia Mazar)। ‘বার আউলিয়া’ গ্রামে বার জন আউলিয়ার মাজারটি অবসি’ত। তবে তাঁদের পরিচয় উদঘাটণ হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইসলাম প্রচারের উদ্যেশে এই বার জন আউলিয়া সুদূর পারস্য ইয়েমেন ও আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে চট্টগ্রামের শহরে আস্তানা গেড়েছিলেন। বার জন অলীর মধ্যে প্রধান হেমায়েত আলী শাহ্‌ (রা.)। তাঁরই নেতৃত্বে আউলিয়াগণ টাঙ্গন নদী বেয়ে অথবা স্থল পথে আটোয়ারীর ওই জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা সবাই আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলেন। হিন্দু ব্রাক্ষণ্যবাদী রাজাদের কঠোর শাসনে নিস্পেষিত নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা বার আউলিয়ার আদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হন।
তারা সম্ভবত সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে এ অঞ্চলে আসেন। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে মাজার সংস্কার করার সময় যে সব পুরাতন চেপ্টা আকৃতির ইট পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই সব ইট কয়েক শত বছর পূর্বে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে দিল্লীর সম্রাট শেরশাহের আমলে এই রকম ইট ব্যবহৃত হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলটি হিন্দু রাজা বা জমিদারের অধীন ছিল। এই মৌজা রানীগঞ্জের জমিদারের অধীনে ছিল। জমিদার মারা যাওয়ার পর রানী রাশমনি এই জমিদারি ষ্টেটটিকে দেবোত্তর ষ্টেট হিসেবে ঘোষণা দেন এবং কানাইলাল দলুইগং জমিদার বার আউলিয়ার অলীদের নামে ৪৭.৭৯ একর জমি ওয়াকফ করে দেন। যা ১৯৪০ সালে রেকর্ডভূক্ত হয়। মাজারের সেবায়েত হিসেবে বাসারত আলী শাহকে দেখানো হয়।
বার আউলিয়ার মৃত্যুকাল এবং তারপর তাদের কবরগুলো ঘিরে তীর্থসমাবেশ কবে থেকে শুরু হয় সেটার সঠিক ইতিহাস জানা যায়না। তবে বোঝা যায় যে, আউলিয়ারা ছিলেন অকৃতদার এবং তাদের মৃত্যুর পর তাদেও ভক্তদের মধ্য হতে পর্যায়ক্রমে মাজার পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে চলে এসেছে। পরবর্তী কালে মাজারের বিশাল সম্পদরাজি খাদেমদের মধ্যকার প্রভাবশালী ভক্তের কর্তৃত্বে চলে যায়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত খাদেম গোষ্ঠির লোকেরা মাজার দেখাশোনা ও জমাজমি ভোগদখল করতেন। বাসারত আলী শাহ এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সুলতান আলী শাহ ও হায়দার আলী শাহ্‌ মাজারের দেখাশোনা করেন। পরে ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জমির রেকর্ড শুরু হলে সুলতান আলী ৪৭.৭৯ একর জমি নিজ নামে রেকর্ড করে নেন এবং মাজারের জমি বিক্রয় শুরু করেন।
জানা যায়, মূল মাজারের চারদিক বিশাল এলাকাজুড়ে ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এই জঙ্গলে অনেক বাঘ, ভাল্লুক, বুনো শুকরসহ হিংস্র জীবজন’ বাস করতো। মাজারের ওপর ছনের ঘর ছিল। ওরশের আগের দিনে মাটি দিয়ে মোছা হতো। কিন’ ১৯৯০ সালের পূর্ব পর্যন্ত একটি টিনের চৌচালা ঘর ছিল। কথিত আছে যে, মাজারে ২টি বাঘ ও ২টি সাঁপ সবসময় পাহারা দিত। মাজারের পাশে ১টি কাঠের বাক্স ছিল। এই বাক্সে ভক্তজনেরা টাকা পয়সা ফেলতো। কেউ টাকা চুরির উদ্দেশ্যে বাক্সের কাছে গেলে সাঁপ দুটি বের হতো। আর বাঘ দুটি ঘরের শরের ওপর বসে থাকত। কখনো দেখা যেত আবার কখনো দেখা যেতনা। তবে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে গেলে বাঘ দেখা যেত। সেজন্য মাজারে কেউ ভয়ে যেতনা। তবে খাদেম বাসারত আলী শাহের স্ত্রী সপ্তাহে একদিন মাটি দিয়ে মুছে দেয়ার জন্য যেতেন। কিন্ত এই মহিলাকে বাঘ কিছুই করত না। বরং মহিলা বাঘের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে নামিয়ে দিতেন। বাঘগুলি নেমে চলে যেত। বর্তমানে সেই গভীর জঙ্গলও নেই। বাঘ সাঁপও নেই।
১৯৯০ সালের দিকে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার আহমদ চৌধুরী একদিন জীপ গাড়ি নিয়ে বার আউলিয়া মাজারের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে মাজারের সামনে রাস্তায় জেলা প্রশাসকের গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পরও গাড়ির ইঞ্জিন চালূ না হলে স্থানীয় জনগণকে জিজ্ঞাসা করেন। জানতে পারেন যে, পশ্চিম পাশে বার আউলিয়া মাজার শরীফ। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি অজু করে মাজার জিয়ারত করে কোন বেয়াদপি হলে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মাজার জিয়ারত শেষে বিনা ধাক্কায় গাড়ি চালু হয়। ওই দিন রাতেই জেলা প্রশাসক স্বপ্নে মাজার উন্নয়নের জন্য বার আউলিয়ার অলীদের নিদের্শ পান। পরের দিন সকাল বেলা তিনি আবার মাজার জিয়ারত করতে আসেন। সেই সঙ্গে তার অসুস্থ দুই পুত্রের জন্য মানত করে মাজার উন্নয়ন কাজে এগিয়ে আসেন। তিনি স্বউদ্দ্যেগে মাজার উন্নয়নে ফান্ড সংগ্রহের জন্য সর্বস্তরের মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক প্রথমে বার আউলিয়ার সর্দার হেমায়েত আলী শাহ্‌ ও নিয়ামত উল্লাহ শাহ্‌ এর মাজারের ওপর একটি পাকা দালান নির্মাণের কাজে হাত দেন। দুজনের মাজার একসঙ্গে আছে। যা জোড়া কবর বলেও পরিচিত। এর পর নলপুখরী গ্রামের মো. খলিলুর রহমান বাকি ১০টি মাজারের দেয়াল নির্মাণ করে দেন। এভাবে সরকারি বেসরকারি সহযোগিতায় সেখানে একটি পাকা মসজিদ ও একটি এতিমখানা নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৯২ সালে প্রাক্তণ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী মরহুম মির্জা গোলাম হাফিজ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর মাজার উন্নয়নের জন্য নজর দেন। প্রথমে জমি নিয়ে মামলার মিমাংসা করে জমি তিনভাগে ভাগ করে দেন। পরে সেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যবস্থা করে দেন। মাজার তদারকির জন্য মির্জা গোলাম হাফিজ জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে দেন তিনি।
প্রতিবছরই বাংলা সনের বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বার আউলিয়া মাজার শরীফের উরস মোবারক বহুপূর্ব হতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই দিন ওয়াজ মাহফিল, কোরআন তেলাওয়াত ও তোবারক বিতরণ করা হয়। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ বিভিন্ন জেলা থেকে এই দিনটিতে মাজারে এসে মানত করেন। গরু, ছাগল, মুরগি, চাউল ও নগদ অর্থও ইত্যাদি দান করেন। লক্ষনীয় বিষয় যে, এদিন সব ভেদাভেদ ভুলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই মাজারে আসেন। উৎসবে পরিণত হয় বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার। সে উৎসব যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়ার উৎসব। সকল স্তরের নারী-পুরুষ পূণ্যভূমিতে এসে মানত পুরা করেন।
এই বারজন আউলিয়ার নাম তাম্রপদে খোদিত ছিল। শোনা যায়, জমিদার কানাইলাল দলুইগং মাজারের জমি দান করার সময় তা সকলের নামে তাম্রপদে দানপত্রটি খোদিত করেন। সেই তাম্রপদটি হারিয়ে গেলেও অলীদের নাম হারিয়ে যায়নি। বার জন আউলিয়া হলেন-হেমায়েত আলী শাহ্‌ (র.), নিয়ামত উল্লাহ শাহ্‌ (র.), কেরামত আলী শাহ্‌ (র.), আজহার আলী শাহ্‌ (র.), হাকিম আলী শাহ্‌ (র.), মনসুর আলী শাহ্‌ (র.), মমিনুল শাহ্‌ (র.), শেখ গরীবুল্লাহ্‌ (র.) আমজাদ আলী মোল্লা, ফরিজউদ্দীন আখতার(র.), শাহ্‌ মোক্তার আলী(র.), শাহ্‌ অলিউল্লাহ (র.)।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: সাফায়েত,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি 22, 2018

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.