অপরূপ সৌন্দর্য্য ও প্রকৃতির অপার লীলায় সজ্জিত বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলা। এ উপজেলার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান হলো তিন্দু(Tindu) । স্থানীয়দের মতে তিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশর অন্যতম ভূ-সর্গ। ভ্রমন পিপাসুদের মতে, পৃথিবী’তে তিন্দু-র মত এমন ঘুম-ঘুম সুন্দর জায়গা আর একটিও নেই। প্রাকৃতিক আকর্ষণের কারণে এ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পর্যটকরা প্রতিদিন আকর্ষণীয় এই পর্যটন স্থানটিতে ভিড় জমান।
আকাশ-কুয়াশা-মেঘ-নদী-পাথর-পাহাড়-ঝরনা-বন-নীল সবুজ পানি আর রহস্য-রোমাঞ্চ-ভয়—সব যদি একবারে পেতে চান, তাহলে জীবনে একবার হলেও ঘুরে আসুন তিন্দু। সকালে ঘরের ভেতরে ফুঁ দিয়ে মেঘ সরিয়ে যখন দরজা খুঁজে বের করতে হয় তখন নিজেকে বারবার ধন্যবাদ দিতে হয় এই দেশে জন্মানোর জন্য।
বান্দরবানের থানচি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট গেলেই পৌঁছে যাবেন তিন্দু। তিন্দু সম্পর্কে একটা বিশাল বই লিখলেও এর সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও তুলে ধরা সম্ভব না। শুধু এতটুকু বলি, মেঘ-কুয়াশার দেশ তিন্দুর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বর্ষাকালে এখানে নৌকায় চড়ে মেঘের ওপরে যাওয়া যায়, সাদাটে মেঘের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ চললেই মাথা ভিজে যায়। এখানে শক্ত কঠিন পাথরকে সারাক্ষণই বুকে নিয়ে লক্ষ্য ছাড়া দৌড়ে বেড়ায় স্বচ্ছ পানির ঢল। নুড়ি পাথরে ছলাৎ ছলাৎ হাঁটতে হাঁটতেই ইচ্ছে করে হাঁটুপানিতে টুপ করে একটা ডুব দিয়ে হাপুস করে খেয়ে নিই পুরো একমুখ টলটলে পানি।
তিন্দুর দুই পাশ দিয়ে চলে গেছে দুটো ঝিরিপথ, সারা দিন সেখান থেকে কলকল করে ছুটে আসছে পাহাড়গলা স্বচ্ছ পানি। পানি আর পাথর মিলে এখানে যে নকশিকাঁথা তৈরি করেছে, কোথাও তার একচিলতে ছিদ্র নেই, নেই অমসৃণতা। তিন্দুপাড়ের পাথুরে সৈকত এখানে যোগ করেছে নতুন একটা মাত্রা। লাখ লাখ অসমান পাথর মিলে তৈরি করেছে অমসৃণ সমান একটা পায়ে চলা পথের, হাঁটতে হাঁটতে পথটা শেষ হলেই মন খারাপ হয়ে যায়, ইচ্ছে করে এখানেই কাটিয়ে দিই আরও একটা বসন্ত।
বান্দরবান-কন্যা তিন্দুকে ফেলে আরও ওপরের দিকে এগোতে থাকলে তখন মনে হবে মিনিটে মিনিটে বদলে যাচ্ছে পানির নিচের পাথুরে জগৎটা, ছোট ছোট পাথর যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে লাগল, উঠতে উঠতে নদীর বুক ফুঁড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল তাদের মাথা। জায়গাটার নাম ‘বড় পাথর’।
এখানে এসে নদীটা হয়ে গেছে সিঁড়ির মতন, এখানে পায়ের পাতাসমান পানিতে নেমে ঠেলেঠুলে নৌকাকে ওঠাতে হয় উপরের দিকে, সেখান থেকে আরও ওপরে একেবারে মেঘের কাছাকাছি। এখানে পাথর আর পানি মিলে ভরদুপুরে তৈরি করে রংধনুর। উত্তুরে হাওয়ায় ভাসতে থাকা সেই রংধনুগুলোকে নিজের কোলে আশ্রয় দেয় নদীর পাড়জুড়ে ঝুলতে থাকা গাছের সবুজ পাতারা। এখানে সূর্যোদয় দেখতে হয় ফুঁ দিয়ে মেঘ সরিয়ে, এখানে সূর্যাস্ত দেখতে হয় পানির চোখে চোখ রেখে।
পানি আর পাথরের এক সাদা-কালো জাদুঘর গড়ে উঠেছে এই তিন্দুকে ঘিরে। এখানে পাহাড়গলা পানিতে পা ডুবিয়ে চলতি পথের নতুন নতুন মাছের সঙ্গে সারা দিন আড্ডা দিলেও ক্লান্তির ঘাম ঝরবে না কানের লতি বেয়ে, এখানে ঘোলাটে মেঘের ভিড়ে সারাক্ষণ ভিজতে থাকলেও এতটুকু ময়লা লাগবে না গায়ে। জল-পাথরের আড্ডা জমে এখানে। এটা মেঘের দেশ, এটা কুয়াশার দেশ, এটা পাথুরে পানির দেশ, এটা তিন্দু, মেঘ-কুয়াশার তিন্দু।
তিন্দুতে গেলে আপনার মনে হবে পৃথিবীতে তিন্দুর মত এমন ঘুম-ঘুম সুন্দর জায়গা আর একটিও নেই। তিন্দু বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। প্রাকৃতিক আকর্ষণের কারণে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী পর্যটকদের কাছে অঞ্চলটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবেই বেশ পরিচিত। তাই আপনি যদি একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে এই স্থানের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার ভুলটি কখনও করবে না।
থাকা খাওয়াঃ
বান্দারবান-থানচি থেকে তিন্দু গেলে সেখানে থাকার অনেক জায়গা পাবেন। এছাড়াও সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বারের তৈরী বাংলোতেও থাকতে পারেন। ইচ্ছে করলে তাবু গেড়েও ওখানে রাত কাটাতে পারেন। খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নাই। খাওয়ার জন্য হোটেল পাওয়া যায় অথবা আপনি যেখানে থাকবেন তারাই রেঁধে দিবে। মুরগীর ঝোল তারা অসাধারন রাঁধে। থাকা খাওয়ার খরচ প্রতিদিন ৪০০ টাকার বেশি হবে না।
কিভাবে যাবেনঃ
তিন্দু যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির গাড়ি ছেড়ে যায়।
যেমন শ্যামলি, হানিফ, ইউনিক, এস আলম, ডলফিন- এর যেকোনো একটি বাসে চড়ে আপনি বান্দরবানের যেতে পারেন। রাত ১০ টায় অথবা সাড়ে ১১টার দিকে কলাবাগান, সায়েদাবাদ বা ফকিরাপুল থেকে এসব বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নন এসি বাসে জন প্রতি ভাড়া ৫৫০ টাকা।
আপনি চাইলে প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। তার পর চট্টগ্রাম থেকে থেকে বান্দরবান হয়েও যেতে পারেন। বদ্দারহাট থেকে বান্দারবানের উদ্দেশে পূবালী ও পূর্বানী পরিবহনের বাস যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ২২০টাকা ভাড়া রাখা হয়।
ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাস চড়লে আপনি সকাল ৭:৩০ এর মধ্যেই বান্দারবান পৌঁছে যাবেন। তারপর বান্দরবান জেলা শহরে নাশ্তা সেরে চান্দের গাড়ি নিয়ে সোজা থানচির উদ্দেশে রওনা হবে।এক্ষেত্রে গ্রুপে গেলে ভালো হয়। তাতে খরচ কম হবে। আপনি চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে নিতে পারেন। তবে এতে খরচ পরবে তিন থেকে চার হাজার টাকা। বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা সদরের দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার।
বান্দরবান শহর থেকে থাচনি যাওয়ার পথে চাইলে মাঝে বলিপাড়ায় কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি নিতে পারেন। সকালে রওনা দিলে দুপুরের মধ্যে থানচি পৌছে যাবেন। থানচিতে ব্রীজ নির্মাণ করায় এখন নদী পার হওয়ার ঝামেলা নেই।তারপর সাংগু হেটে পার হয়ে থানচি বাজারে পৌঁছাবেন।
তবে এক্ষেত্রে আপনাকে সবার আগের যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে বিজিবিকে আপনার পরিচয় দিয়ে তাদের নিকট থেকে অনুমতি নেওয়া। যাত্রা পথে যে বাজারটি পরবে সেখান থেকে খাওয়া দাওয়া করে নিতে পারেন। খুব সুলবেই আপনি এখান থেকে খাওয়া দাওয়ার করতে পরবেন।
বাজার থেকে অপনাকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। এখানে আলাদা কোন গাইড পাওয়া যায় না। তাই নৌকার মাঝিই আপনার গাইডের কাজ করবে। নৌকা ভাড়ার খরচ নির্ভর করবে দিনের পরিমানের ওপর। নৌকা ভাড়ার জন্য আপনাকে দিনপ্রতি প্রায় ৮শ থেকে ৯শ টাকা গুনতে হবে।
মোবাইল নেটওয়ার্কঃ
থানচি, তিন্দু দুই জায়গাতেই মোবাইল নেটওয়ার্ক (জিপি, রবি, টেলিটক, সিটিসেল) আছে। নিজের মোবাইল সাথে না নেয়াই ভালো। বাড়তি বোঝা বলে মনে হবে। দোকান থেকেই প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিতে পারবেন। নিলেও নোকিয়া জাভা সেট নিয়ে যাবেন, চার্জ অনেক দিন থাকে।