সোনাদিয়া দ্বীপ – কক্সবাজার

সোনাদিয়া দ্বীপ কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলার প্রায় ৯ বর্গ কিমি. আয়তনের ছোট একটি অপরূপ  সুন্দর দ্বীপ। অপরূপ সৌন্দর্যের আধার এ দ্বীপটি  কক্সবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে এবং মহেশখালি দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে  অবস্থিত। এই দ্বীপটি  একটি খাল দ্বারা  মহেশখালি দ্বীপ থেকে বিছিন্ন হয়েছে। কথায় আছে যে কয়েকশ বছর পূর্বে পর্তুগীজ জলদস্যুদের হামলায় এখানে একটি স্বর্ণবোঝাই জাহাজ ডুবে যায় এবং পরবর্তীতে জাহাজের ধ্বংসস্তূপকে ঘিরে একটি দ্বীপ জেগে ওঠে।এটাই হচ্ছে সোনাদিয়া দ্বীপ(Sonadia Dbip),আর একে স্থানীয় ভাষায় সোনাদিয়া চর বলে। সোনাদিয়া দ্বীপের সৌর্ন্দয্য দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন।

কক্সবাজারের আকর্ষনীয় স্থানসমূহের মধ্যে সোনাদিয়া দ্বীপ একটি। নয়নাভিরাম এই দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়্।ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় বনের সমন্বয়ে গঠিত এই দ্বীপটির না দেখে বিশ্বাস করা সম্ভব না। তিন দিকে সমুদ্র সৈকত, সাগর লতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া- নিশিন্দার ঝোপ, এবং ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন দ্বীপটিকে করেছে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। সাগরের গাঢ় নীল জল, লাল কাঁকড়া, কেয়া বন, সব মিলিয়ে এক ধরনের রোমাঞ্চিত পরিবেশ সবসময় বিরাজ করে এই দ্বীপে। বিভিন্ন অতিথি পাখি এবং জলচর পাখির একটি অভয়ারণ্য হল সোনাদিয়া দ্বীপ। এ দ্বীপকে যাযাবর পাখিদের জন্য ভূ-স্বর্গ বলা যায়।  এখানে আসা পাখিদের মধ্যে রয়েছেঃ পেট্রেল, স্নাইপ, শ্যাঙ্ক, তিতির এবং নানা জাতের হাঁস।

সমুদ্র থেকে সৃষ্টি হয়ে একটি খাল ভিতরের দিকে গিয়ে কয়েকটি শাখা প্রশাখায় ছড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে।এ খালের পানি এতোটাই স্বচ্ছ ও টলটলে যে, দেখে মনে হবে যেন কোনো কাঁচের ওপর দিয়ে নৌযানটি এগিয়ে চলেছে। যা দেখলে শত বছরের দু:খ-কষ্ট এক নিমিষেই ভুলে যেতে বাধ্য। খালের দুপাশে সবুজ বন। এ বনে রয়েছে কেওড়া, হারগোজা, উড়িঘাস এবং কালো ও সাদা বাইন বৃক্ষ।

দ্বীপটির পশ্চিম দিকে সবুজ ঘাসে মোড়ানো খোলা মাঠ, নির্জনতা ও অফুরন্ত বাতাস, সব মিলিয়ে মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে। এই দ্বীপের খোলা মাঠে বসলে মনে হবে যেন অজানা-অচেনা কোনো দ্বীপে আপনি একা। চারপাশে লাল কাঁকড়ার ছুটাছুটির দৃশ্যগুলো খুবই মনোরম। সবকিছুই মনে হবে কাল্পনিক কোন দৃশ্যের মতো,কিন্তু তা বাস্তব। সোনাদিয়া দ্বীপের সূর্যাস্ত আরও  অসাধারণ। সন্ধ্যায় সাদা পালক দুলিয়ে সারি সারি বক উড়ে যায় আপন ঠিকানায়। নীল আকাশের কপালে কে যেন দেয় লাল টিপ। আস্তে আস্তে যখন সূর্য হারিয়ে যায় সাগরের বুকে, তৈরি হয় এক মোহনীয় পরিবেশ।

এখানে রাত্রিযাপন হতে পারে আপনার জীবনের সেরা রাতের একটি। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে এই সোনাদিয়ার সৈকতে একটা রাত ক্যাম্পিং আর বার বি কিউ পার্টি করে দেখতে পারেন, দুনিয়াটা কত সুন্দর। বন্ধুরা মিলে তাবু নিয়ে কয়েকদিনের জন্য ছুটে যেতে পারেন নির্জন এই দ্বীপে। সোনাদিয়া দ্বীপে ঘুরাঘুরি ও ক্যাম্পিং করার জন্য সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সম্পূর্ণ নিরাপদ। এই দ্বীপের যে বিষয়টি পর্যটকদের মনে সারাজীবন স্থান করতে সক্ষম সেটি হলো এখানকার চা। অত্যন্ত সাধারণ মানের হলেও এখানকার চায়ের স্বাদ কখনো ভুলবার নয়।

এটি দেশের প্রধান শুটকি মাছ উৎপাদন কেন্দ্র। শীতকালে এখানে হাজার হাজার জেলে ঘাঁটি গাড়ে এবং তাদের ধরা মাছ শুটকি বানানোর জন্য শুকাতে দেয়।এখানে প্রচুর মাছ শুকানো  হয়  যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করা  হয়।এই দ্বীপ মাছ শুকানোর জন্য বিখ্যাত।এখানকার সৈকতে বিভিন্ন ধরনের শামুক এবং প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যায়।একসময় গোলাপি মুক্তার জন্য এই দ্বীপের খ্যাতি ছিল।

সোনাদিয়া দ্বীপে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা –

সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেল নেই। খাওয়ারও তেমন কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় লোকজনকে টাকা দিলে তারা খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। আর সোনাদিয়া দ্বীপে রাত্রি যাপনের ক্ষেত্রেও ভরসা সেই স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে রাতে থাকার কষ্টের কথা চিন্তা করে যারা সূর্যাস্ত আগেই ফিরে আসবেন তারা সোনাদিয়া দ্বীপের আসল সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবেন।

রাত্রী যাপন করতে চাইলে স্থানীয়দের বাসায় থাকতে হবে, এক্ষেত্রে গিয়াস উদ্দিন নামে ঐ এলাকার এক ছেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে, বিনিময়ে তাকে কিছু দিয়ে দিলেই হবে। আগে থেকে বলে রাখলে টাটকা সামুদ্রিক মাছ বা শুটকি রেঁধে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিবে, আগেও উনি বেশ কিছু ট্যুরিস্টকে এ ব্যাপারে হেল্প করেছেন। এছাড়া চাইলে বন বিভাগের অফিসে থাকতে পারেন, সেক্ষেত্রে ওখানকার স্টাফদের অনুমতি নিতে হবে।

সোনাদিয়া দ্বীপে কিভাবে যাবেনঃ

ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর ও দেশের যে কোনো স্থান থেকে বাস, ট্রেন বা অন্য কোনো যানবাহনে করে প্রথমে যেতে হবে কক্সবাজার। কক্সবাজার কস্তুরী ঘাট থেকে স্পিডবোট বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে যেতে হবে মহেশখালী। এক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে কলাতলী বা লাবণী পয়েন্ট থেকে কক্সবাজারের ৬ নং ঘাট এ আসতে হবে। ওখানে মহেশখালী যাওয়ার জন্যে স্পীড বোট পাবেন, ভাড়া প্রতিজন ৭৫ টাকা, মহেশখালী ঘাটে পৌঁছতে সময় লাগবে ১২-১৫ মিনিট। স্পীড বোটে চড়তে ভয় লাগলে কাঠের বোটে চড়ে আসতে পারেন, ভাড়া ৩০ টাকা, সময় লাগবে ৪৫-৫০ মিনিট।

মহেশখালী ঘাটে নেমে রিক্সা নিয়ে চলে আসবেন গোরকঘাটা বাজারে, ভাড়া ২০ টাকা। এরপর আপনাকে যেতে হবে ঘটিভাঙ্গায়, মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙার দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। ৩-৪ জন হলে একটা সিএনজি নিয়ে যেতে পারেন ঘটিভাঙ্গা, ভাড়া ১৫০-১৭০ টাকা।

সেখান থেকে আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সোনাদ্বিয়া দ্বীপে যেতে হয়। ঘটিভাঙা নেমে খেয়া নৌকায় সোনাদিয়া চ্যানেল পার হলেই সোনাদিয়া দ্বীপ। ভাটার সময় খালে খুব বেশি পানি থাকেনা। সোনাদিয়া যাওয়ার দুটো উপায় আছে। হেঁটে যাওয়া অথবা জোয়ার এলে নৌকা। প্রতিদিন জোয়ারের সময় পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত মাত্র একবার একটি ট্রলার ছেড়ে আসে। সাধারণত সকাল ১০ টা বা ১১ টার দিকে ছাড়ে। এই ট্রলারটিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের তুলে নিয়ে আবার ফিরে যাত্রা করে।৪০-৫০ মিনিটের মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন সোনাদিয়ায়, ভাড়া প্রতিজন ২৫ টাকা ।

বোট থেকে নেমে কাছেই বন বিভাগের একটা বিল্ডিং আছে, ওখানে রেস্ট নিতে পারেন, কিংবা কিছুক্ষণের জন্যে বসে আড্ডা দিতে পারেন পাশের ঝাউবনে । এরপর স্থানীয়দের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে চলে যেতে পারেন বীচে, ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই দেখা পাবেন সমুদ্র সৈকতের ।

ঘটিভাঙ্গা থেকে হেঁটে হেঁটেও সোনাদিয়া যাওয়া যায়, তবে তা একটু কষ্টকর। হেঁটে গেলে আপনাকে সোনাদিয়া পুর্ব পাড়ায় যেতে হবে, ওদিকে থাকা খাওয়ার কোন ব্যবস্থা এখনও হয়নি, তাই পশ্চিম পাড়া চলে যাওয়াটাই ভালো।

উল্লেখ্য, কক্সবাজার থেকেও সরাসরি স্পিডবোট রিজার্ভ করে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওযার ব্যবস্থা রয়েছে। সে জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। যারা ভ্রমণকে অ্যাডভেঞ্চারময় করতে ভালোবাসেন তারা কিছু বাড়তি খরচ করে কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পিড বোটে করে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে পারেন।

আরেকটা সুখবর, এখন সরাসরি গাড়িতে করে মহেশখালী যাওয়া যায়। যারা বোটে চড়তে ভয় পান বলে স্থলপথে আসতে চান বা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে যেতে চান তাদেরকে কক্সবাজার থেকে বা ঢাকা/চট্টগ্রাম থেকে আসার পথে চকরিয়া নামতে হবে। চকরিয়া থেকে জীপ/সিএনজিতে করে বদরখালি এবং তারপর জীপ/সিএনজিতে করে গোরকঘাটা বাজারে যেতে হবে।

বিঃ দ্রঃ কক্সবাজার থেকে একদিনে সোনাদিয়া ঘুরে আসা সম্ভব না, হাতে অন্তত দুইটা দিন সময় নিয়ে বের হোন, তাহলে সোনাদিয়ার পাশাপাশি মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, রাখাইন পাড়া, বৌদ্ধমন্দির, চরপাড়া, লবণের মাঠ, পানের বরজ- সবকিছু ভাল মত দেখতে পারবেন। রিক্সায় উঠার আগে আশেপাশের স্থানীয় কারো কাছ থেকে ভাড়াটা জেনে নিবেন, তারপর দরদাম করে উঠবেন, নয়তো কিছু কিছু রিকশাওয়ালা খুব ঝামেলা করে।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: ভ্রমণ পাগল,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: February 12, 2018

সোনাদিয়া দ্বীপ – কক্সবাজার, সম্পর্কে পর্যটকদের রিভিউ।

  1. “কয়েক শত বছর পূর্বে পর্তুগীজ জলদস্যুদের হামলায় এখানে একটি স্বর্ণ বোঝাই জাহাজ ডুবে যায় এবং পরবর্তীতে জাহাজের ধ্বংস স্তুপকে ঘিরে এই দ্বীপটি জেগে উঠে ”
    – What is the source of this?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.