পাকশী রেল সেতু – কুষ্টিয়া

পদ্মার কোলে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ছেয়ে থাকা দক্ষিণ জনপদের দ্বারপ্রান্তর ভেড়ামারা ও পাকশী বেড়ানোর এক অপরূপ নিসর্গে পরিণত হয়েছে। এখানে এলে রূপসী পদ্মার ঢেউয়ের কলধ্বনি, চারদিকে সবুজের বেস্টনী ও উত্তাল হাওয়ার পরশে যেমন হৃদয় ভরিয়ে দেয়। তেমনি এ এলাকায় রয়েছে ইতিহাস ও প্রাচীন কীর্তিসহ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দেশের বৃহত্তম রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালন শাহ সেতু। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্নে সমৃদ্ধ ভেড়ামারা পর্যটনের মনোরম স্পটে সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরো একটি অন্যতম স্থান। প্রতিদিন শত-সহস্র দর্শনাথীর ভিড়ে মুখর হয়ে থাকে ভেড়ামারা-পাকশীর উভয় পাড়। সকাল-বিকাল মনে হয় যেন এক মিলনমেলা। স্ব-চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না।
ভেড়ামারার অন্যতম কীর্তি হলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দক্ষিণ পাশে লালন শাহ সেতু। যমুনা সেতুর অনুরূপ লালন শাহ সেতু বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সড়ক সেতু। প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর ১ হাজার ৭৮৬ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ৭.৫ মিটার দুই লেন বিশিষ্ট এ সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে এবং সেতুর উভয় পাড়ে দুটি টোল প্লাজা যেন আরো শ্রীবৃদ্ধি করেছে। এই সেতুর পূর্ব প্রান্তে ১০ কি.মি. ও পশ্চিম প্রান্তে ৬ কি.মি. রাস্তাটি সৌন্দর্য কেড়েছে। লালন শাহ সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং পরিবহন ব্যবস্থার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রবীণদের কাছে ‘সাড়া পুল’। আজ যাদের বয়স ৮০/৯০ বছর তাদের কাছে সাড়া পুল ছিল এক স্বপ্ন। যমুনায় সেতু যেমন এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন তেমনি ভেড়ামারায় লালন শাহ সেতু স্বপ্নের বাস্তবায়ন। প্রবীণরা জানান, ১৮৯০ সালে শিলিগুড়ি মিটারগেজ রেলপথ স্থাপিত হলে প্রমত্তা পদ্মার এক তীরে সাড়া ঘাট ও অন্য তীরে দামুকদিয়া ঘাটের মধ্যে চলাচল শুরু হয় রেল, ফেরি ও স্টিমার। ১৯১০ সালে পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এই দুরূহ কাজ করতে গিয়ে বিশ্বে প্রথম রিভার ট্রেনিং ও গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয় পদ্মার উভয় পাড়ে। প্রায় ৮ কিলোমিটার উজান থেকে গাইড ব্যাংক বেঁধে এনে ১৯১২ সালে শুরু হয় রেল সেতুর কাজ। এভাবে পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে রেল সেতুর কাজ শুরু হয়। এরপর নরম পলিমাটিতে স্প্যান নির্মাণ ছিল আরেকটি দুরূহ কাজ। রিভার বেড বা নদী শয্যার নিচে ১৯০ থেকে ১৬০ ফুট গভীরতায় কূপ খনন করে স্থাপিত হয় স্প্যান। এভাবে প্রতিটি ৫২ ফুট উচ্চতার ১৫টি স্প্যান ও দুপাশে শক্ত কাঠামোর ল্যান্ড স্প্যানের ওপর ৫ হাজার ৮৯৪ ফুট দীর্ঘ রেল সেতু নির্মাণ করা হয়, যা আজ এক অমর কীর্তি হিসেবে স্থান পেয়েছে। তৎকালীন প্রকৌশলী জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রবার্ট উইলিয়াম গেলস ও ফ্রান্সিস স্প্রিংগের নকশায় ব্রেইন্স ওয়ালটি এন্ড ক্রিম নামের প্রতিষ্ঠান এই রেল সেতু নির্মাণ করে। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি মালবাহী বগি নিয়ে একটি ইঞ্জিন সেতু অতিক্রম করে। জানা গেছে, সোনা মিয়া নামে এক চালক প্রথম ইঞ্জিন নিয়ে পাড়ি দেন সেতু। এরপর ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন ভাইস লর্ড হার্ডিঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে সে সময়ের বৃহত্তম রেল সেতুটির উদ্বোধন করেন। সেই থেকে প্রথম ডবল লাইনের এই রেল ব্রিজের নাম হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে এই সেতু। বিজয় অর্জনের মাত্র ৫ দিন আগে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণের মুখে মরণ কামড় দেয়। দুটি স্যাবর জেট বিমান দিয়ে বোমা ফেলা হয় ব্রিজটিতে। বোমার আঘাতে ১২ নম্বর স্প্যানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর ধ্বংস্তুপ বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে সাড়া দেয় বিশ্বসংস্থা। ব্রিটিশ সরকার ও ভারত সরকার অতি দ্রুত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মেরামত করে দেয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পুনরায় রেল চলাচল শুরু হয়। আজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে লালন শাহ সেতুর ভেড়ামারা ও পাকশীর উভয় পাড়। আরো দেখার মতো রয়েছে ভেড়ামারা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ জিকে সেচ প্রকল্প। ওপারে পাকশীতে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভাগীয় অফিস, উত্তরবঙ্গের কাগজ কল, ইপিজেড ও ঐতিহাসিক ভারতবর্ষের ফুরফুরা খানকা শরিফ এবং পাকশীর রূপপুরের ঐতিহ্যবাহী বিবিসি বাজার। আরো দেখার মতো রয়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্থপতি রবার্ট উইলিয়াম গেলসের তৈরি একটি বাংলো। প্রকৌশলী উইলিয়াম গেলের নামানুসারে ‘গেলে কুঠি’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলোটি। এই বাংলোতে বসেই তিনি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নকশা জরিপ এবং নির্মাণ কৌশল উদ্ভাবন করেন। বাংলোটিও তাই কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। খুব সহজেই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে। রেল বিভাগের শহর পাকশীর আরেক ঐতিহ্য ন্যারো গেজ রেলপথ। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রেলপথের ব্রড গেজ ও মিটার গেজ অতি পরিচিত। একদিন এ দেশেই ছিল মিটার গেজেরও ছোট ন্যারো গেজ রেলপথ। পাকশী রেল বিভাগের অফিসের সামনে দেখা মেলে ন্যারো গেজ রেলপথ ও বাচালিত ইঞ্জিন। সবই কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। পাকশীতে আরো দেখা যায় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। এ বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল ভারতের প্রখ্যাত কবি শক্মখ ঘোষসহ বহু গুণীজনের। শিক্ষার প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠটি দেখতে গেলে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের মুখে স্মৃতির দুয়ার খুলে নিয়ে যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ রূপপুর বাজারেরই এক কড়ইতলায় কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতেন আশপাশের গ্রামের মানুষ। সেই থেকেই বিবিসি বাজার নামে আজও পরিচিত হয়ে আছে বাজারটি।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: সাফায়েত,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: April 21, 2017

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.