পল্লী কবির বাড়ি – ফরিদপুর

কবি জসিমউদ্দীনের বাড়ি (Palli Kabi Jasim Uddin er Basvabon) ফরিদপুরের অম্বিকাপুর। নিস্তব্ধ গ্রাম। স্রোত হীন কুমার নদ। খোলা বাতাস। প্রকৃতির দৃশ্য মন কেড়ে নেয়। কুমার নদের পশ্চিমেই কবির বাড়ি। প্রবেশ করতেই পল্লী গ্রামের প্রকৃতি যেন আমার অনুভূতি স্পর্শ করে স্বাগত জানাচ্ছে। চারিদিকের গাছপালা, বাগান, কবির সমাধি ক্ষেত্র, পাখির কিঁচির মিচির শব্দ। কবির বাড়ী-আঙ্গিনায় চারটি দোচালা টিনের ঘর। তাতে লেখা; কোনটি কার ঘর। দক্ষিণে কবির ঘরে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় চার পাশটা ঘুরেই দেখতে হলো। বারান্দায় ছোট ছোট পাটের ছিকা। ভিতরে নকসা করা মাটির রঙিন কলস রাখা। কিছক্ষণ কবির ঘরের আশে পাশে ঘুরলাম। অনুভূতিতে অনুভব করছিলাম।

অতি সাধারণ ঘরেই জন্ম নিয়েছেন এই কবি। ছোট্ট টিনের ঘরেই জসিমউদ্দীনের জন্ম। কবির স্মৃতিঘরে বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি তুলে চার দেয়ালে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কবির জীবনের ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিস। তার কাঠের আলমারি, থেকে শুরু করে আছে একটা সুন্দর পালকিও।

কিন্ত স্মৃতিঘরের দুটি আলমারিতে সাজানো অসংখ্য মাটির পুতুল সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে দর্শনাথীদের। মজার ব্যাপার হলো প্রিয় কবির প্রিয় পুতুল; স্মৃতিঘরে পুতুলগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সকলকে। স্মৃতিঘরের সামনে একটি সাইনবোর্ডে বিশ্বকবির লেখা। জসিমউদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা, রস ও বর্ণ নতুন মাত্রার।

উঠানের পূর্ব দিকে এখনও ঢেকি-ঘরটি’ স্মৃতি স্বরূপ আছে। ঢেকি-ঘরের সামনে কবির লিখা কিছু কথা মনকে ছুঁয়ে গেল। “আমাদের গরীবের সংসার। ঘি-ময়দা-ছানা দিয়ে জৌলুস পিঠা তৈরীর উপকরণ মায়ের ছিলো না। চাউলের গুড়া আর গুড় এই মাত্র মায়ের সম্পদ।”

কথাগুলোর মাঝে ছিলো একরাশ মায়া, আবেগ অন্যদিকে মায়ের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিক। কতো অল্পতেও মানুষ সুখি হতে পারে- পল্লী কবি তার ভাষায় প্রকাশ করে গেছেন।

ঢেকি-ঘরের পাশেই আরেকটি ঘর। কবির এই ঘরে ঢুকেই অনেক ছবির মাঝে কবি পত্নী‌ মমতাজ জসিমউদ্দীনের ছবিটি দেখলাম। ৯ম শ্রেণীতে পড়াকালীন ১৪ বছর বয়সী এই কিশোরীকে কবি তার স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। বিয়ের আরো অনেক আগেই জসিমউদ্দীন তাঁর অমর “কবর” কবিতাটি রচনা করেন, যেটি ছিল তার স্ত্রীকে নিয়েই লিখা।

ঘরের দেয়ালজুড়েও অনেক স্মৃতি কথা, টুকরো কাহিনী। বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিষগুলো এখনও কবির ইতিহাস। জীবনধারার প্রতিচ্ছবি। আছে তার ব্যবহারের কলম, বিভিন্ন বই খাতা ও অন্যান্য সামাগ্রি। সেখানেও রয়েছে অনেক মাটির ও তুলার পুতুল। ঘরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে কবির নিজ জীবনের বিভিন্ন কথা লিখা যা ছবির মতই টানানো।

ঘরজুড়ে কবির এতো স্মৃতিচিহ্ন, কবির অস্তিত্ত্বটাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কবির ঘরের সামনেই কবির নিজ হাতে লাগানো একটি গাছের সামনে দাড়ালোম। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় লাগানো সেই গাছ আজও তাঁর বাড়িটিকে সাজিয়ে রেখেছে। আর তার বাড়ির পল্লী প্রকৃতিকে আরো সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেছে।

কবির সাথে প্রকৃতির যে কি নিবিড় সম্পর্ক। তা তাঁর বাড়িটি দেখলেই ধারনা করা যায়। কবির লাগানো সেই গাছগুলিতে ঝুলছে বিভিন্ন মাটির কলসি। সেই গাছে নাকি পাখি বাসা করতো, তাই সে সেইসব কলসি বেঁধে রাখতো যাতে পাখির নিশ্চিন্তে তাঁর গাছে থাকতে পারে। কতটা পল্লী প্রকৃতির প্রেমিক ছিলেন পল্লী জসিমউদ্দীন। পুরো বাড়িই সেটির প্রতিচ্ছবি।
কবির লাগানো গাছ আর পাখিদের জন্য এই সুব্যবস্থা দর্শনার্থীদের সাথে কবির হৃদয়ের মিলে যাওয়া জায়গাটাকে আরো অনেক স্পষ্ট করে তুলছিলো।

এবার উঠান থেকে বেরিয়ে, বেশ কিছুটা পূর্ব দিকে ২০১১ সালে নির্মিত কবির পিতা আনসার উদ্দীনের স্মৃতিঘরটি দেখতে গেলাম।

অন্যসব ঘরের থেকে কিছুটা ভিন্নতায় সাজানো এ ঘরটি। পুরো ঘরজুড়ে পাটের ছিকা যার ভিতরে মাটির কলস দিয়ে সাজানো। কাঠের আলমারি, ব্যবহৃত জিনিস ও বিভিন্ন ছবি রাখা। ঘরে মাঝখানে কাঁচের চারকোনা বাক্সে রাখা সে সময়কার ব্যবহৃত শাড়ি, চাঁদর, টাইপ ম্যাশিন, কলম ইত্যাদি। রয়েছে ব্যবহৃত মাটির পাত্র এবং আরো অনেক কিছু। সেই ঘরে রয়েছে কবির পিতা মাতার ছবিসহ তাঁর পুরো বংশ পরিচয়। এবার আমি কবি ও তার পরিবারের অনেক সদস্যের কবরের সামনে এসে দাড়ালোম। মাটি থেকে কিছুটা উচু সেই জায়গাটি।

আকাশে মেঘ থাকা সত্বেও ছুটে বিরামহীন বয়ে চলা কুমার নদের শীতল বাতাসে বেড়ালাম। এই নদের পরিচ্ছন্ন জলে আজো যেন মিশে আছে কবির স্মৃতি। বয়ে যাচ্ছে কুমার নদ, থেমে নেই সময়, বন্ধ হয়ে গেছে শুধু একরাশ রঙ্গিন স্বপ্নে ঘেরা কবির দুটি চোখ। ডালিম গাছের ঠিক নিচে নিশ্চল, নিশ্চুপে থাকা পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের সমাধী সামনে গিয়ে নিরুপায় লেখকের কন্ঠে উচ্চারিত হলো এই কথা, “এই খানে পল্লী কবি, ঘুমায় ডালিম গাছের তলে,
লাখো ভক্ত এই জনপ্রিয় কবিতাটির রচয়িতা কবি জসীম উদ্দীন।

কিভাবে যাবেন

ফরিদপুর বাসষ্ট্যান্ড হতে ২ কিঃ মিঃ দূরে।  রিক্সা/অটোরিক্সা/মাইক্রোবাস যোগে যাওয়া যায়।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: আবদুর রহমান,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: April 7, 2018

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.