তৈদুছড়া (ঝর্ণা) – খাগড়াছড়ি

তৈদুছড়া ঝর্ণা (Toiduchora jhorna/ Waterfall) নামে এই ঝর্ণাটির নাম প্রচলিত থাকলেও এখানে ঝর্ণা শব্দটির ব্যবহার নেই। কারন, স্থানীয়দের ভাষায় তৈদু অর্থ পানির দরজা বা জানালা। আর ছড়া মানে ঝর্ণা। তাই স্থানীয় ত্রিপুরা আদিবাসীরা এ ঝর্ণাটির নাম দিয়েছে ‘তৈদুছড়া’ । সে থেকেই ছড়াটির নাম তৈদুছড়া আর এলাকার নাম তৈদুপাড়া।

খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দীঘিনালা উপজেলার জামতলি পোমাংপাড়া হয়ে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তৈদুছড়া ঝর্ণা।

পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিঁচু মেঠ পথ পেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ঝরণা ও অন্যতম জলপ্রপাত এ তৈদুছড়া ঝর্ণা দেখতে দীঘিনালা হতে সব মিলিয়ে তৈদুছড়া পর্যন্ত পৌছতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লাগে। তবে তা নির্ভর করে হাঁটার গতির উপর। সুতরাং সকালে রওয়ানা দিলে অনায়েসেই সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসা সম্ভব। এই আসা যাওয়ার পথটি মোটেও বিরক্তিকর নয়।

হাঁটতে হাঁটতে যতটা না ক্লান্তি আপনাকে গ্রাস করবে তার চাইতেও বেশি গ্রাস করবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেশা। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে আপনি আসক্ত হবেনই।

কেবল দীঘিনালা থেকে তৈদুছড়া নয়, খাগড়াছড়ি প্রবেশের পর হতে আপনার জন্য কেবল বিস্ময় অপেক্ষা করবে। যে দিকেই চোখ যাবে কেবল সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ আর সাদা কুয়াশার মত মেঘ আপনাকে মোহে ডুবিয়ে রাখবে। পাহাড়ের পর পাহাড়, মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঘর। এমন নির্জন আর নির্মল প্রকৃতি হয়তো কখনো আপনি আর দেখেননি। অবাক হয়ে শুধু ভাবতে হয় বাংলার প্রকৃতি এত সুন্দর কেন?

আকাশ আর পাহাড়ের মিতালি আপনাকে বিমুগ্ধ করবে আর ভ্রমণেন সময় কেটে যাবে মুহূর্তের মাঝে। চাপ্পাপাড়া কিংবা পোমাংপাড়া হতে দুর্গম পথ, অনেকগুলো ঝিরি, উচু নিচু পাহাড়, কোথাও হাটু সমান আবার কোথাও বুক সমান পানি আর বুনো জঙ্গল পাড়ি দিয়ে অবশেষে প্রায় তিন ঘন্টা হাঁটার পর আপনি পৌছবেন ১ম ঝর্ণাটিতে।

এটি প্রায় ৬০ ফুট উঁচু। ঝর্ণামুখ হতে পানি পাহাড়ের গায়ে পড়ে তা পাহাড় বেয়ে নিচে এসে ছোট একটি হ্রদের সাথে মিলিত হয়েছে। অসাধারণ সেই দৃশ্য।

প্রথম ঝর্ণার ডানপাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠলে খুব কাছাকাছি পেয়ে যাবেন ২য় ঝর্ণাটি। এখানে প্রায় ৮০-৮৫ ডিগ্রি এঙ্গেলের ঢাল বেয়ে বানরের মত প্রায় ১০০ ফুট ওপরে উঠতে হবে। ওপরে উঠলে প্রথমেই চোখে পড়বে ঝর্ণামুখ যেখান হতে ১ম ঝর্ণার পানি পড়ছে। ২য় ঝর্ণা হতে ঝিরি পথে পানি আসছে এখানে।

ঝিরি পথ ধরে প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটলে পরে পৌছানো যায় ২য় ঝর্ণাটিতে। এই চলার পথটি যেমন কষ্টকর তেমনি রোমাঞ্চকর আর সুন্দর। উপর থেকে প্রচণ্ড বেগে পানি নেমে আসছে। এই বেগ ঠেলে পানি বরাবরই হাঁটতে হয়। ডানে বায়ে যেখানে পানির স্রোত কম সেখানে শ্যাওলা জমেছে। একটুতেই পা পিছলে যায়। মাঝে মাঝে এখানে পানির স্রোত খুব বেশি যে ধাক্কা দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে চায়। তাই এখানে পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে হাঁটতে হবে। একবার পিছলে গেলে কয়েকশ হাত দূরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। এখান থেকে আরো ওপরে উঠতে হবে। চলার পথে পারি দিতে হবে বড় বড় পাথর আর কোমর সমান পানি। অতপর পেয়ে যাবেন দ্বিতীয় তৈদু ঝর্ণা।

অপূর্ব আর নয়নাভিরাম সে ঝর্ণা। এটি এতই দৃষ্টিনন্দন আর ব্যতিক্রম যে কারো আর তড় সইবে না। ঝর্ণার নিচে ঝাপিয়ে পড়তে মন চাইবে। ঝর্ণাটি প্রায় ৮০ ফুট উঁচু। ঝর্ণার পানি এসে সরাসরি যেখানে পড়ছে সেখানে সিড়ির মত অনেকগুলো পাথুরে ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে। ধাপগুলোতে দাড়িয়ে অনায়েসেই গোসলের কাজটি সেরে নেয়া যায়। দীর্ঘ ক্লান্তিকর হাঁটার কষ্ট মুহূর্তেই ধুয়ে যাবে ঝর্ণার জলে। ঝর্ণার জলের শীতল পরশ আপনাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে আবার কতটা পথ হাঁটতে হবে ফেরার জন্য।

এখানে সারা বছরই পানি থাকে। শীতে জল প্রবাহ কমে যায়। আর বর্ষার হয়ে উঠে পূর্ণ যৌবনা। তবে শীতের আগে ও বর্ষার শেষে এখানে ঘুরতে যাওয়া উত্তম সিদ্ধান্ত। ঝর্ণার আশে পাশে কেবল যেন সবুজেরই সমারোহ।

পাশের পাহাড় গুলোতে চলে জুম চাষ। পাহাড়ের সবুজের মাঝে জুম ফসলের মাঠ যেন যোগ করেছে ভিন্ন এক সবুজের। মনে হবে যেন সবুজের মাঝে সবুজের আঁচর।

শুধু তাই নয় এখানকার আদিবাসীদের আথিতেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবে। আদিবাসীদের সাথে পরিচয় ও আলাপচারিতা আর যাত্রা পথের দৃশ্যাবলী অবলোকন হতে বঞ্চিত হলে আপনার তৈদুছড়া ভ্রমণটি অপূর্ণই থেকে যাবে।

জলপ্রপাত, ঝিরি, পাহাড়ি জীবন, আকাশ আর পাহাড়ের মিতালী, শিবছড়ি পাহাড়ের পাথরের শিব মূর্তি, পাথরের হাতি ও পাথরের সাপ সব কিছু মিলিয় আপনার চোখ ভরে যাবে তৃপ্তিতে, আপনি তুলবেন প্রাপ্তির ঢেকুর।

তৈদুছড়া কিভাবে যাবেনঃ

সংক্ষেপেঃঢাকা > খাগড়াছড়ি > জামতলি বাজার > তৈদুছড়া ঝর্ণা

ঢাকা থেকে বাসে করে খাগড়াছড়ি। কিছু পরিবহন প্রতিদনিই ছেড়ে আসে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।

তৈদুছড়া ঝর্ণা দেখতে জীপে করে যেতে হবে জামতলি বাজারে। সেখানে রবি, টেলিটক বাদে বাকি সব সিমের নেটওয়ার্ক থাকে না। সুতরাং এখানে অথবা সাজেক গেলে রবি, টেলিটক সিম নিবেন। জামতলি বাজার থেকে ইজি বাইকে ১০টাকা ভাড়া দিয়ে মাস্টারবাড়ি।

প্রথমবার গেলে অবশই বিশ্বস্ত লোকাল গাইড নিয়ে নিবেন। তাহলে পথ হারানো, সহজ পথ পেতে কষ্ট হবে না।

তৈদুছড়া ভ্রমন টিপসঃ

  • তৈদুছড়া-১ ঝর্ণার সামনের পানির অংশ অনেক গভীর এবং পাশের পাথরও বেশ পিচ্ছিল। তাই যারা সাতার জানেন না তারা অবশ্যই পানিতে নামবেন না।
  • ভাল গ্রিপার স্যান্ডেল পড়ে নিবেন, তবে কর্দমাক্ত জায়গা গুলা খলি পায়ে পার হবেন নাহলে কাঁদা স্যান্ডেল টেনে ধরবে।সাথে মোটা, শক্ত দড়ি নিবেন যা অনেক কাজে দিবে।
  • ভারি ব্যাগ নিবেন না।সাথে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার/খেজুর নিবেন।
  • জোঁকের জন্য লবন/গুল নিবেন।
  • কামেরা/মোবাইলের জন্য পলিথিন/প্লাস্টিক রেইন কাভার নিবেন।
  • এসব জাগায় মশা প্রচুর। ওডোমস ক্রিম ব্যবহার করবেন, ম্যালারিয়া প্রতিষেধক ওষুধ নিয়মিত সেবন করবেন।

এই ট্রেইলটা বর্ষার সময় বেশ কঠিন। তাই আমি বলব দুর্বল, বয়স্ক, শিশুদের সাথে না নেয়াই উত্তম।

কোথায় থাকবেনঃ 

খাগড়াছড়িতে পর্যটন মোটেল সহ বিভিন্ন মানের থাকার হোটেল (Hotel) আছে । তবে দীঘিনালায় থাকার জন্য ভাল ব্যবস্থা বলতে একটি। সেটি হল দীঘিনালা রেস্টহাউজ।

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: ভ্রমণ পাগল,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: December 4, 2019

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.